বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন ও শেখ হাসিনার জয়ের খবর
Share on:
বহুল আলোচিত এবং প্রতিক্ষীত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকারপ্রধান হওয়ার অনন্য নজির গড়তে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত কয়েক দিন ধরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে এসেছে। আর রোববারের এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের জয়ের পর সেই সংবাদও বেশ গুরুত্ব দিয়ে শিরোনামে এনেছে বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা, টিআরটি ওয়ার্ল্ডসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, বিতর্কিত নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয় নিশ্চিত করার পরে শেখ হাসিনা আরও পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করতে চলেছেন।
প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচন বর্জন করায়, শেখ হাসিনার দল এবং মিত্ররা বাকি আসনগুলোতেও জয়ী হবে বলে আগেই আশা করা হয়েছিল। বিএনপি এই নির্বাচনকে বানোয়াট বলে অভিযোগ করেছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৪০ শতাংশেরও কম ভোটারের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। যদিও সমালোচকরা বলছেন, ভোটার উপস্থিতির এই হার বাড়িয়ে বলা হতে পারে। অবশ্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৮০ শতাংশের বেশি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বলছে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার পঞ্চম মেয়াদে জয় নিশ্চিত করেছেন। প্রধান বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। রোববারের এই নির্বাচনের চমক হচ্ছে দ্বিতীয় অবস্থানে যারা এসেছে।
কোনও রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মোট ৬৩টি আসন পেয়েছে, যা হাসিনার আওয়ামী লীগের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আর এটি দেশটিতে সংসদীয় বিরোধী দল খুঁজে পেতে সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
নির্বাচন কমিশনের মতে, বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে মাত্র ১১টি আসন পেতে সক্ষম হয়েছে।
আল জাজিরা বলছে, প্রায় সব বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীই এমন লোক ছিল যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, কিন্তু দলের নেতৃত্ব তাদের ‘ডামি প্রার্থী’ হিসাবে ভোটে দাঁড়াতে বলেছিল, যাতে নির্বাচনকে বিশ্বের সামনে একটি প্রতিযোগিতামূলক ভোট হিসেবে দেখানো যায়।
প্রখ্যাত বাংলাদেশি অধিকার কর্মী এবং ফটোগ্রাফার আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘এটি একটি উদ্ভট নির্বাচনের একটি উদ্ভট ফলাফল। ডামি নির্বাচনে ডামি প্রার্থীরা এখন ডামি সংসদে যাবে।’
বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ নির্বাচনে তার দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন নিশ্চিত করার সাথে সাথে প্রত্যাশা অনুযায়ী টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়লাভ করেছেন। প্রধান বিরোধী দলের বয়কট করা রোববারে এই ভোটে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম।
২০১৪ সালে বর্জনের পর প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০১৮ সালের ভোটে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে শেখ হাসিনা তাদের পদত্যাগের দাবি প্রত্যাখ্যান করার পরে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন দিতে অস্বীকার করার পর বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করে।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। আর সর্বশেষ নির্বাচনে এই জয় তার জন্য সামগ্রিকভাবে পঞ্চম মেয়াদে দায়িত্বপালনের সুযোগ দেবে।
বিগত ১৫ বছরে ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি অর্থনীতি এবং বিশাল গার্মেন্টস শিল্পকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কৃতিত্ব পেয়েছেন। পাশাপাশি প্রতিবেশী মিয়ানমারে নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক প্রশংসাও অর্জন করেছেন।
তবে রোববারের নির্বাচন থেকে বাংলাদেশিরা অনেকটাই দূরে ছিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার এদিন ভোট দিয়েছেন। যদিও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত আগের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৮০ শতাংশের বেশি।
বার্তাসংস্থা এএফপি বলছে, বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কটের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার পঞ্চম মেয়াদে জয়ী হয়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। যদিও তিনি বিরোধী দলকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বার্তাসংস্থাটি বলছে, শেখ হাসিনা একসময় দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তার সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্মমভাবে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ রয়েছে।
রোববারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আসনগুলোতে প্রার্থীরা প্রায় কোনও কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়নি। তবে সংসদকে এক-দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত করা এড়াতে আপাত প্রচেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ কয়েকটি আসনে প্রার্থী দেওয়া এড়িয়ে গেছে।
বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর নেতাকর্মীরা ব্যাপক গণগ্রেপ্তারের শিকার হয়েছে। রোববার নির্বাচনের দিন দলটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং এই দলটির সঙ্গে আরও কয়েক ডজন দল ‘ভুয়া নির্বাচনে’ অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলছে, বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো জয়ী হয়েছেন। এর মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী নারী সরকার প্রধান হিসেবে নিজের খেতাব বজায় রেখে টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব পেয়েছেন শেখ হাসিনা।
১৭ কোটি জনসংখ্যার আবাসস্থল বাংলাদেশ এই বছর দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে নির্বাচন আয়োজন করে। তবে ভোটার উপস্থিতি ছিল বেশ কম। আনুমানিক ১২ কোটি যোগ্য ভোটারের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ এদিন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছেন।
শেখ হাসিনা পদত্যাগের দাবি প্রত্যাখ্যান করার পর প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচন বয়কট করে। বিরোধীরা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনার দাবি জানিয়েছিল।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, শেখ হাসিনা এবং তার সরকার একদলীয় ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সমালোচকরা রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ভোটারদের ভয় দেখানোর খবরেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অর্থনৈতিক নানা উদ্বেগও এই দেশটিকে ঘিরে রয়েছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশকে মুদ্রানীতি কঠোর করতে এবং বিনিময় হারের নমনীয়তা আরও বেশি নিশ্চিত করার কথা জানায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
বার্তাসংস্থা এপি বলেছে, বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নানা সহিংসতা এবং প্রধান বিরোধী দলের বয়কটের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। এই ভোটে তিনি এবং তার আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন রোববারের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করতে ধীরগতি দেখিয়েছে। আওয়ামী লীগ ২৯৯টি আসনের মধ্যে দুই শতাধিক আসনে জিতেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬০টির বেশি আসনে এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টি ১১টি আসনে জয় পেয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করে বলেছে, বাংলাদেশের ভোটাররা সরকারের একতরফা নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
বাদশা মিয়া নামে ঢাকার একজন রিকশাচালক বলেছেন, নির্বাচনে যথেষ্ট সংখ্যক প্রার্থী না থাকায় তিনি ভোট দেবেন না।
সাকিবুল হাসান চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ীও তাই মনে করেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে কোনও বিরোধী দল নেই এবং আমার পছন্দের কোনও প্রার্থীই নেই। তাহলে আমি কীভাবে ভোট দিয়ে উপকৃত হবো?’
হাবিবুর রহমান নামে একজন ছোট ব্যবসায়ী বলেছেন, তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন। তবে তিনি আরও বলেছেন, নির্বাচনে খুব বেশি ভোটার উপস্থিতি নেই বলে মনে হচ্ছে।
সমালোচক এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত বিগত দুটি নির্বাচন ভোট কারচুপির অভিযোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল এবং এর মধ্যেই বিরোধী দলগুলো আরেকটি নির্বাচন বয়কট করল।
এছাড়া ফরাসি সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স২৪ ছাড়াও মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ, ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দু, তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন ও শেখ হাসিনার টানা চতুর্থ মেয়াদে জয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।
এনএইচ