স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার জনগণের মানবাধিকার হরণ করেছে: মুজিবুর রহমান
Share on:
বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা এবং সারাদেশে গুপ্ত হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তীব্র নিন্দাও প্রতিবাদ ।
মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এক প্রেস ব্রিফিং-এ বক্তব্য রাখেন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বর্তমান স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের শাসনামলে জনগণের ভোটাধিকার, বেঁচে থাকা ও মত প্রকাশের অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকারসহ সকল মৌলিক মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে। বর্তমানে যাদের বয়স ৩৩ বছর, তাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলেও ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ায় গত ১৫ বছর যাবত তারা তাদের ভোট প্রয়োগ করতে পারছেন না। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়ে সরকার নির্বাচনের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করে আবারো ক্ষমতা দখলের জন্য আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন দ্বারা দেশবাসীর দাবি উপেক্ষা করে তফসিল ঘোষণা করেছে।
প্রায় সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং পেশাজীবী সম্প্রদায়সহ দেশের জনগণ এই ফরমায়েসি তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। দলীয় লোকদেরকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে এবং ডামি প্রার্থী ঘোষণা করে সরকার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নিজেদের দলীয় নির্বাচনে পরিণত করেছে এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে একটি প্রহসনের নাটকে রূপ দিতে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের সকল নিয়ম-কানুন পদদলিত করে ঘুষ, ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে কিছু লোককে বাগিয়ে নিয়ে বিরোধী প্রার্থী ঘোষণা করে গণতান্ত্রিক ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমরা সরকারের এই অপরাজনীতির ধৃক্কার জানাচ্ছি।
সরকারের সাজানো ও প্রহসনের নির্বাচনকে সফল করার লক্ষ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদেরকে মিথ্যা ও বায়বীয় মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হচ্ছে। বর্তমানে বিরোধীদলের ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী কারাগারে আটক রয়েছেন। নির্বাচনকে সফল ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের আটকের পাশাপাশি বিচার বিভাগকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আদালত মানুষের সর্বশেষ আশ্রয় স্থল। আদালতকে অপব্যবহার করে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচারে দমন-পীড়ন চালিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। দেশে আইনের শাসনকে বিপর্যয় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। নি¤œ আদালতে সরকারের ছক অনুযায়ী বিচার কার্য চালানো হচ্ছে ও রাজনৈতিক নেতাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এমনকি সকল নিয়ম লঙ্ঘন করে গভীর রাত পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুনানি ছাড়াই বিরোধীদলের সম্ভাব্য নির্বাচনী প্রার্থীদেরকে দ্রæত সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, যা বিচারক ও বিচার ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে।
এই পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী দলসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের ৭ শতাধিক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদÐ দেয়া হয়েছে। আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোঃ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগরী নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য করার এবং কারাগারে আটক রাখার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। গত ৩ ডিসেম্বর, দীর্ঘ ১১ বছর আগে ২০১২ সালে দায়ের করা রামপুরা থানার একটি সাজানো মামলায় উল্লেখিত নেতৃবৃন্দসহ ৭২ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচারের নামে প্রহসন করে তাদেরকে শাস্তি দেয়ার চক্রান্ত চলছে। আদালতকে অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করে দেশের বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে ফেলেছে।
সরকার বিরোধীদলের ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করছে। আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের আটক করার জন্য সরকার সারা দেশে গণগ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাসা-বাড়িতে হানা দিয়ে নেতাকর্মীদের না পেলে পরিবারের অন্য লোকদের গ্রেফতার করে জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। বাড়িতে অবস্থানরত লোকদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে এবং অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে। বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হচ্ছে।
তাদের হাত থেকে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ লোকেরাও রেহাই পাচ্ছেন না। হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এমনকি মসজিদ থেকেও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এভাবে জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। এ ধরনের কালো আইন এর সাহায্য নিয়ে এবং পুলিশকে দলীয় পেটুয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষ লক্ষ লক্ষ পরিবারের সদস্যদের বাড়িছাড়া করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে সকল মানুষকে নিরাপদভাবে বেঁচে থাকা ও বসবাস করার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু বর্তমান এই গণবিরোধী ও মানবতা বিরোধী সরকার আজ দলীয় বাহিনী এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে গুপ্ত হত্যার অভিযান শুরু করেছে। সম্প্রতি রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, যশোর জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা নম্বরবিহীন গাড়ীতে চড়ে জামায়াতসহ বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে হাতুরি ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এবং ছুরিকাঘাত করে হত্যা করছে এবং গুরুতরভাবে আহত করে রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে।
উল্লেখিত জেলাগুলোতে অতি সম্প্রতি এ ধরনের ২০টি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহীতে দুজন জনপ্রিয় ও অভিজ্ঞ ডাক্তার যথাক্রমে ডা. এরশাদ আলী দুলাল ও ডা. গোলাম কাজেম আলী আহমাদকে হত্যা করা হয়েছে। রংপুরে ৩ নং পায়রাবন্দ-এর ইউপি চেয়ারম্যান জনাব মাহবুবুর রহমানকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বগুড়া ও নওগাঁয় দুজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। নাটোরের নলডাঙ্গা ও সিংড়া উপজেলায় গুপ্ত হামলার শিকার হন মাওলানা আবু নওশাদ নোমানি ও গ্রাম্য ডাক্তার আলাউদ্দিন। আবু নওশাদ নোমানিকে হেলমেট বাহিনী পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। এ অবস্থায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে ব্যাপক মারধর করে। থানার ওসি তাকে আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। ওসি তার বুকে লাথি মারে। পুলিশের আঘাতে তার হাত ভেঙ্গে যায়। পুলিশের এই ভূমিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও মানবতাবিরোধী।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারী বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের উপর চোরাগুপ্তা হামলা চালানো হচ্ছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে বাসা-বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে না, রাস্তায়ও নামতে দিচ্ছে না। অতি সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইলে, চট্টগ্রামে, ফেনীতে ও আশুলিয়ায় আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকাশ্য দিবালোকে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও শ্রমিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে হত্যা করছে ও আহত করে সারা দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
পুলিশ এসব ঘটনার কোনো মামলা নিচ্ছে না। শুধু তাই নয়, জামায়াতের কারাবন্দি আমীর ডা: শফিকুর রহমানের সিলেটের বাসায় গত ২২ নভেম্বর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তল্লাশি চালিয়ে পরিবারের লোকদের হয়রানি করেছে। এসব ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, দেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। বিরোধীদলকে নির্বাচনের বাইরে রাখাই সরকারের মূল উদ্দেশ্য। এভাবে বাংলাদেশকে বসবাসের অযোগ্য দেশে পরিণত করা হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে জনসমর্থনহীন সরকার চোর-ডাকাতির কায়দায় নির্বাচন করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশ আজ এক কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ক্ষমতার জন্য রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দলীয় ক্যাডার ও বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার করে সরকার সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের কর্মকাÐে প্রতীয়মান হচ্ছে তারা কোনো বিরোধীদলকে থাকতে দিতে চায় না। তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতকে নির্মূল করবে। দেশের রাজনৈতিক দল ও নেতাদেরকে নির্মূল করার মাধ্যমে দেশকে বিদেশী শক্তির বিচরণ ক্ষেত্র বানানোর জন্য আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র করছে।
আওয়ামী লীগের এ ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জনগণের অধিকার আদায় করতে হলে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন আরও তীব্র থেকে তীব্রতর করার জন্য এবং আমীরে জামায়াতসহ সকল নেতৃবৃন্দ, আলেম ওলামাদের মুক্তি, কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা ও সন্ত্রাস নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এবং ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে সব কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, তা সর্বাত্মকভাবে সফল করার জন্য জামায়াতের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, শুভাকাক্সক্ষী, সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল ও দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহŸান জানাচ্ছি।
আপনারা অতীতে কলম সৈনিক হিসেবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তা জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে। তদ্রƒপ বর্তমান স্বৈাচারের বিরুদ্ধেও জনগণের অধিকার আদয়ের লক্ষ্যে আপনাদের প্রতি মজবুত ভূমিকা পালনের আশাবাদ ব্যক্ত করছি এবং আপনাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
এই সভায় উপস্থিত ছিলেন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ-এর সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আবদুর রহমান মুসা প্রমুখ।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি