আজ পিলখানা ট্রাজেডির ১৪ বছর, হয়নি কোনো মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি
Share on:
২০০৯ সালের আজকের দিনে অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বর্বর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড। পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেন ৫৭ জন সেনা অফিসারসহ মোট ৭৪ জন।
সেদিন বাংলাদেশের বীর সন্তানদের লাশ দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সারাদেশ। দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম দিনের ১৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ শনিবার।
বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা। দীর্ঘ বিচার ও রায় শেষে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।
বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও আসামিদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া কোনো মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। নিম্ন আদালত থেকে হত্যা মামলার রায় উচ্চ আদালত হয়ে এখন আটকে আছে আপিল বিভাগে।
২০২০ সালে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে খালাস চেয়ে ২০৩ আসামি আপিল করেন। আর ৮৩ জনের সাজা বৃদ্ধি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে করা হয় ‘লিভ টু আপিল’।
এ অবস্থায় এখন আপিল শুনানির উদ্যোগ নিলে বিচারের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। যদিও এরপর রিভিউ আবেদনের সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
হত্যাকাণ্ডের দিন যেমন ছিল পিলখানার পরিস্থিতি
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটের দিকে তৎকালীন বিডিআরের বার্ষিক দরবার চলছিল। এসময় পিলখানার দরবার হলে ঢুকে পড়েন একদল বিদ্রোহী সৈনিক। তাদের একজন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করেন। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একে একে হত্যা করা হয় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে। বিদ্রোহীরা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারটি প্রবেশ গেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশেপাশের এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকেন তারা।
বিদ্রোহীরা দরবার হল ও এর আশপাশে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর গুলি চালাতে থাকেন। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে পিলখানা থেকে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, নয় বিজিবি সদস্য ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। মামলায় সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগ পত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা হয় ৮৫০ জন। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড ও ২৭৮ জনকে খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া চারজন আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তারা অব্যাহতি পান।
আদালতের রায় ঘোষণার পর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে যায়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আসামিরা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল ও জেল আপিল করেন। এর মধ্যে ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন। আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুনানি শুরু হয়।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সবাই বিডিআর সদস্য ছিলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন। ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু।
হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। একইসঙ্গে আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়।
এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এদের মধ্যে দু’জন আসামির মৃত্যু হয়েছে ও ১২ জন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
বিডিআর পুনর্গঠন ও বিজিবি গঠন
পিলখানায় এই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরিবর্তন করা হয় বিদ্রোহের আইন।
শনিবার নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণ করবে দেশ
পিলখানা ট্র্যাজেডির দিনটিতে নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে বিজিবি। বিজিবি জানায়, পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহীদদের স্মরণে শনিবার শাহাদাতবার্ষিকী পালন করা হবে।
এছাড়া শনিবার সকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। দিবসটি পালন উপলক্ষে বিজিবির সব স্থাপনায় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে ও বাহিনীর সদস্যরা কালো ব্যাজ পরিধান করবেন। এছাড়া বিজিবির সব সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হবে।
এন