tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশনার সময়: ২৩ জুন ২০২২, ১৭:২৩ পিএম

দুর্গম পাহাড়ে আধিপত্তের লড়াই, এক বছরে ২১ খুন


Pahar-66

রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে বাবা-ছেলেসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের গ্রুপের অস্ত্রধারীরা। এর আগে বান্দরবানে এক পাড়াপ্রধান ও তার চার ছেলেকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এভাবে পাহাড়ে রক্ত ঝড়েই চলছে। এ যেনো মানুষের রক্ত নিয়ে খেলা করা। পাহাড় দখলের লড়াইয়ে এ ধরণের সহিংসতা চলছে দীর্ঘ দিন ধরেই কেউ থামাতে পারছে না। পাহাড়ে প্রাণহানির ঘটনা কিছুতেই থামছে না।


কিছু দিন পরই সন্ত্রাসী দলগুলোর মধ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে লাশ পড়ছে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় গত এক বছরে সন্ত্রাসীদের হাতে কমপক্ষে ২১ জন নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম বড়থলি ইউনিয়নে দুর্বৃত্তের গুলীতে বাবা-ছেলেসহ তিনজন নিহ হলো।

কিছুদিন আগে বান্দরবানে এক পাড়াপ্রধান ও তার চার ছেলেকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করার একদিন পরই জেএসএসের এক সাবেক কর্মীকে গুলী করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার কয়েকদিন আগে বান্দরবানের রুমা জোনের একটি টহল দলের সঙ্গে জেএসএস মূল দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলী বিনিময়ের ঘটনায় সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার নিহত হন। এসময় তিনজন সশস্ত্র সন্ত্রাসীও নিহত হন। গুলীবিদ্ধ হয় একজন সেনা সদস্য।

কিছু দিন পর পরই পাহাড়ে হত্যাকান্ডের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে পাবত্য অঞ্চলে। এতে চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন পাহাড়ের মানুষ। হিসাব মতে গত এক বছরে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলায় সন্ত্রাসী হামলায় ২১ জন নিহত হয়েছেন। চলতি বছরের ফেব্রয়ারিতেই নিহত হন ১০ জন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতারাও হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। আত্মগোপনে থেকে চালাচ্ছেন শান্তিচুক্তি বিরোধী তৎপরতা। গহীন পাহাড়ে আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে আঞ্চলিক নেতারা জোট বাঁধছেন নিজের দেশের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে শঙ্কিত ও আতঙ্কিত পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ। পাহাড়ে আসলে হচ্ছেটা কী, কারাই-বা দেশের বিরুদ্ধে করছে ষড়যন্ত্র; এসব প্রশ্ন হচ্ছে জোরালো। জেএসএসের বাইরেও পাহাড়ে তৎপরতা বেড়েছে ইউপিডিএফসহ কয়েকটি সশস্ত্র দলের। তাদের উপস্থিতি ও চলাফেরায় ফের সন্ত্রস্ত অবস্থায় আছে বাংলাদেশের পার্বত্য জনপদ। একেবারে দুর্গম পাহাড়েও তাই লেগেছে চাপা উত্তেজনার আঁচ। তিন দেশের সীমান্তের সবচেয়ে কাছের পাড়া ধোপানীছড়া। ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সশস্ত্র গোষ্ঠীর আনাগোনা বেশি বেড়েছে এর উত্তরের শিপ্রু পাড়া থেকে দক্ষিণে জারুছড়ি পাড়া পর্যন্ত। নতুন করে এলাকাগুলো দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে তারা।

জানা গেছে, দুর্গম এ সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ চলছে এবং বেড়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিওপি। সতর্ক নজরদারি আছে সেনাবাহিনীরও। তবে নানা প্রতিকূলতায় ভরা বিশাল এ জনপদকে নিশ্ছিদ্র রাখা সহজ কাজ নয়। জনসংহতি সমিতি (সন্তু), ইউপিডিএফ-প্রসিতসহ কয়েকটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র অবস্থানের খবর পাওয়া যায় তিন পার্বত্য জেলার আরও অনেক গ্রামে। শান্তিচুক্তির পরে অস্ত্র যেভাবে জমা হওয়ার কথা ছিল, অস্ত্রগুলো সেভাবে জমা হয়নি।

সন্ত্রাসীদের কাছে এখনও সেসব অস্ত্র রয়ে গিয়েছে। নতুন অস্থিরতার শঙ্কায় বথি পাড়া, রুমার যে গ্রামে সবশেষ রক্ত ঝড়েছে। এখানকার মানুষের ভয়ের কারণ হচ্ছে চুক্তি ভেঙে আবারও আগের পথে যাচ্ছে হয়তো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো। বথিপাড়ার এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেছেন, আমরা তো শান্তিতেই থাকতে চাই। পরিবার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ভাল থাকতে চাই।

এদিকে গত বছরের (২০২১) ২৫ ফেব্রুয়ারী বাঘাইছড়ি রূপকারী ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার সমর বিকাশ চাকমাকে গুলী করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ৪ মার্চ রাঙ্গামাটির লংগদুতে নদীতে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার হয় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ। ১ এপ্রিল রাঙ্গামাটি বাঘাইছড়িতে সহকর্মীর গুলীতে জে এস এস এমএন লারমা দলের সশস্ত্র কমান্ডার বিশ্ব চাকমা ওরফে যুদ্ধ নিহত হন । ১০ এপ্রিল রাজস্থলী সীমান্ত সড়কে ১ শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয় । ২০২১ সালের ১৫ জুন রাঙ্গামাটি জুরাছড়ি উপজেলার লুলাংছড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলীতে কার্বারী (গ্রাম প্রধান) নিহত হন। ২০ জুন বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গুলী করে হত্যা করে এক যুবককে। ২৭ জুন খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ইউপিডিএফ’র কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করে। ২৮ জুন বান্দনবানের নাইক্ষংছড়ির সীমান্তে অজ্ঞাত পুরুষের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।

১০ জুলাই রাঙ্গামাটি রাইখলীতে সন্ত্রাসী দলের দুই গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ১ জন নিহত হন। ১৮ জুলাই খাগড়াছড়ির পানছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলীতে খল কুমার ত্রিপুরা নামে এক যুবক নিহত হন। ১৯ জুলাই বান্দরবানে এক পল্লী চিকিৎসককে অপহরণের পর গুলী করে হত্যা করা হয়। ২৫ জুলাই রাঙ্গামাটি মগবান এলাকায় বাসিরাম তংচঙ্গ্যা নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২৭ আগস্ট খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ইছাছড়ি এলাকার পাহাড়ের ঢালুদে যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর বাঘাইছড়ির মধ্যম বঙ্গলতলী এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলীতে একজন নিহত হন।

১৮ সেপ্টেম্বর বাঘাইছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলীতে বাসায় নিহত হন সুরেশ চাকমা নামে একজন। ১৬ অক্টোবর কাপ্তাই চিৎমরমে আওয়ামীলীগের ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নেথোয়াই মারমাকে গুলী করে হত্যা করা হয়। ২৩ নভেম্বর বান্দরবানে সন্ত্রাসীদের গুলীতে আওয়ামীলীগের নেতা উথোয়ানু মারমা নিহত হন। তার স্ত্রী হন গুলীবিদ্ধ। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর রাঙ্গামাটির বন্দুকভাঙ্গা এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলীতে জনসংহতি সমিতির-জেএসএস এর নেতা আবিস্কার চাকমা নামে একজন নিহত হন।

সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে ‘জেএসএসের সাবেক কর্মী’কে গুলী করে হত্যা করা হয়। এর একদিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে ৪ ছেলেসহ পাড়াপ্রধানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন, আবুপাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) লকরুই ম্রো (৭০) এবং তার ৪ ছেলে রুনতুই ম্রো (৩৫), রেংঙি ম্রো (৩০), মেনওয়াই ম্রো (২৫) ও রিংরাও ম্রো (২০)।

এদিকে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম বড়থলি ইউনিয়নে দুর্বৃত্তের গুলীতে বাবা-ছেলেসহ তিন জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার এ তথ্য জানিয়েছেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ইউনিয়ন সভাপতি আতুমং মারমা। বড়থলি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি সদস্য ওয়েইবার ত্রিপুরাও একই তথ্য জানিয়েছেন।

আতুমং মারমা বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ‘কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ’ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কর্মীরা বড়থলি ইউনিয়নের সাইজান নতুন পাড়ায় এলোপাতাড়ি গুলীবর্ষণ করে। এতে ঘটনাস্থলেই বৃষচন্দ্র ত্রিপুরা, সুভাষ ত্রিপুরা ও তার ছেলে ধনরা ত্রিপুরার মৃত্যু হয়। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।

তিন জন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউপি সদস্য ওয়েইবার ত্রিপুরা বলেন, নতুন সৃষ্ট ওই পাড়াতে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মাত্র তিনটি পরিবার বসবাস করতো। এলাকাটি দুর্গম। নিহত তিনজনের মধ্যে দু’জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- চিতারাম ত্রিপুরা (৬৫)এবং বিশ্ব চন্দ্র ত্রিপুরা (৪৯)।