একযুগেও বিচার হয়নি সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার
Share on:
নাছির উদ্দিন শোয়েব: সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার একযুগ পূর্ণ হলো আজ। দীর্ঘ ১২টি বছরেও আলোচিত এ হত্যা মামলার প্রকৃত খুনিদের চিহ্নিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে’ অপরাধী গ্রেফতারে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই আশ্বাসের পর এখন পর্যন্ত তদন্তের জন্য সময় নেয়া হয়েছে ১০৫ বার!।
এতটি বছরেও কেউ জানে না কারা খুন করেছে কিংবা কেন এই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছে। তদন্ত থমকে আছে একই বৃত্তে। শুধু প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পরিবর্তন ছাড়া দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এরই মাঝে সম্প্রতি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের এক বক্তব্যে আরও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে পরিবার, স্বজন ও সহকর্মীদের মাঝে। গত এক ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ঘটনায় সঠিকভাবে দোষী নির্ণয়ে তদন্তের জন্য প্রয়োজনে ৫০ বছর সময় দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। যদিও তিনি পরে আরেক বক্তব্যে বলেছেন, আলোচিত মামলাটির সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন।
এদিকে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ১০৫ বারের মতো পিছিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করেছেন আদালত। গত ২৩ জানুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। তদন্ত সংস্থা র্যাব প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিন প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নতুন এদিন ঠিক করেন।
চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের ঘটনার অনুসন্ধান করা সাংবাদিকদের অনেকে মনে করেন, তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত কয়েকবছর নীরবতা পালন করায় তদন্ত কাজে আরো বেশি ব্যাহত হচ্ছে। এই ঘটনা নিয়ে সেসময় সাংবাদিক সংগঠনগুলো ব্যাপক আন্দোলন করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা স্তিমিত হয়ে যায়। এই ইস্যু নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কার্যকরভাবে চাপ প্রয়োগ করা যায়নি। এ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। তবে শিগগিরই তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। বেডরুম থেকে ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় বাসায় ছিল তাদের একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ। ঘটনাস্থলে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার’ মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। দুই দিন পর তৎকালীন পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। তখন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দুই মাস তদন্তের পর ‘ব্যর্থতা’ জানালে আদালত র্যাবকে তদন্তভার দেন। এই খুনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো ডিএনএ নমুনার পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে মামলার রহস্য উদঘাটন হবে বলে এর আগে র্যাবের কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছিলেন। তবে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলেই যে অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব হবে - তেমনটি নাও হতে পারে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, র্যাবের প্রতিটি অগ্রগতি প্রতিবেদনেই ‘গুরুত্বসহকারে তদন্ত চলছে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় ২০০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে। সন্দিগ্ধ আসামীদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের নাম ও ঠিকানা যাচাই এবং পূর্ব ইতিহাস জানার জন্য গতিবিধি, চাল-চলন গভীর ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়। ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার কথা বলা হলেও চুরি যাওয়া ল্যাপটপ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে।
২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দাখিল করা এক প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেছে। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুজন পুরুষের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রফাইল পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃত আট আসামী, নিহত দুজন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি। এই মামলায় গ্রেফতারকৃত আটজনের মধ্যে পাঁচজন- ফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীরকে।
এদের মধ্যে তানভীর, মিন্টু ও পলাশ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছে। বাকিরা এখনো কারাগারে আছে। মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলম রোমান তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে নিজের হতাশা প্রকাশ করে বলেন, মামলাটি ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তদন্ত সংস্থা কোনো রুলই প্লে করছে না। এক তদন্ত কর্মকর্তা যান, আরেক তদন্ত কর্মকর্তা আসেন। বারবার সময় নেওয়াই যেন তদন্তের অংশ হয়ে গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে যারা ছিলেন, তাদের একাধিকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা কেস হিস্ট্রিই জানেন না। তিনি বলেন, ডিবি তদন্ত শেষ করতে না পেরে আদালতে ক্ষমা চেয়েছে। পরে র্যাব তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে। তারা বারবার সময় চাচ্ছে। কিন্তু তারা যে কিছু করতে পারছে না, তা-ও বলছে না, ব্যর্থতার দায়ও নিচ্ছে না, তদন্তও শেষ হচ্ছে না। দিনশেষে আমরা বিচার চাই। আমরা চাই হত্যাকারীরা শনাক্ত হোক, আইনের আওতায় আসুক, বিচার হোক। এর বাইরে কিছু চাওয়া নেই।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানিয়েছে, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হতাকান্ডের এগার বছর পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রকৃত হত্যাকারীদের এখনো চিহ্নিত করা যায়িনি। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে রোববার ১১ ফেব্রুয়ারি ডিআরইউ চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।