আকবর দ্য গ্রেট : বিদায়ী শ্রদ্ধার্ঘ্য
Share on:
অজয় দাশগুপ্ত : আমাদের দেশে এখন গুণী মানুষের অভাব প্রকট। মেধার দেশ, মেধাবী সমাজ তারপরও এই অচলায়তনের কারণ সবার জানা । কিছুদিন আগে লেখক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন, এখন আর কোনো গবেষক, বিজ্ঞানী, পণ্ডিত দেখি না, যে দিকে তাকাই শুধু প্রশাসক। আজকের বাংলাদেশ পুলিশ প্রশাসক রাজনৈতিক নেতা আর অর্থবানদের ভিড়ে পরিপূর্ণ । সাথে আছে লুটেরাদের ভিড়। এরা এখন মিডিয়াজুড়ে এতো দাপটের সঙ্গে থাকে যে বাকীরা আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ে । পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। সে নিয়মের চাপে ধীরে ধীরে আকবর আলি খানও চলে গিয়েছিলেন অন্তরালে।
ড. আকবর আলি খান কলাম লিখতেন। আমি যখন ‘সংবাদ’-এ নিয়মিত কলাম লিখতে শুরু করি তখন তিনি সেখানকার নামী কলাম লেখক। তাঁর প্রত্যেকটি লেখা পড়ে মনে হতো দরবার-ই জহুর, সন্তোষ গুপ্ত বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো কারো লেখা পড়ছি। তখনকার বিবাদমান দুই রাজনৈতিক দলের কাউকে তিনি ছাড় দিতেন না। খালেদা জিয়াকে আমরা যতো গালামন্দ করি না কেন তার সময় কথা বলা যেতো। তার বিরুদ্ধে বলতে ভয় ছিল না এমন না; তবে কম। এরশাদ আমলে যেমন তার বিরুদ্ধে এন্তার বলার রেওয়াজ থাকলেও ভয় ছিল বেশি। খালেদা জিয়ার আমলে বলা যেতো বলেই আকবর আলি খান তাকে বলেছিলেন, ধমক দেবেন না, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই সাহস থাকাটা যেমন গৌরবের তেমনি আমাদের সমাজে বিপদেরও। বিপদ কি বা কত প্রকার তা আমাদের চাইতে ভালো কে জানে?
তার অসাধারণ স্মৃতিচারণে তিনি মুজিবনগর সরকারের সময়ের চিত্র তুলে ধরেছিলেন নিপুণভাবে। লিখছেন: যুদ্ধের সময় আমাদের শঙ্কা ছিল আরও দুটি। একটি শঙ্কা ছিল, পাকিস্তানের ‘মুরুব্বি’রা কেউ হস্তক্ষেপ করে কিনা। এক মুরব্বি ছিল চীন। চীন যদিও হইচই করছিল, কিন্তু শীতকালে তার সামরিক হস্তক্ষেপের ক্ষমতা ছিল সীমিত। মূল চিন্তার কারণ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিক্সনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অবস্থান নিয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে। এরা যে কেবল কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছিল তা-ই নয়, সামরিক পেশি শক্তিও প্রদর্শন করছিল। শেষ মুহূর্তে মার্কিন নৌবহর বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধ জাহাজও পাঠিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে আমরা শুধু যুদ্ধের সংবাদ নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম না, একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন ছিলাম পাকিস্তানি মুরুব্বিদের ক্রিয়াকলাপ নিয়েও।
দ্বিতীয় শঙ্কার কারণ ছিল ঢাকা দখল নিয়ে। যুদ্ধের আগে পাকিস্তানি বাহিনী ছড়িয়ে ছিল সারা দেশে। অনুমান করা হচ্ছিল, সর্বত্র এরা যৌথ বাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি বাহিনী এ কৌশল পরিবর্তন করে। অল্প কয়েকটি অবস্থান ছাড়া এরা সম্মুখভাগ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে তাদের নিয়ে আসে ঢাকার দিকে। এতে অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ঢাকা শহরে পাকিস্তানি বাহিনী কেন্দ্রীভূত করে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ধরনের বিশ্লেষণে আমরা সবাই ঘাবড়ে যাই। কারণ, আমাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজনই তখন ঢাকায় অবস্থান করছিল। তাই সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হলে পাকিস্তানি বাহিনী যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হতো, এর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো ঢাকায় অবস্থানরত আমাদের স্বজনেরা। আমাদের পরম সৌভাগ্য, শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের পক্ষে ঢাকা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। একসময় যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’, তারা প্রায় সমগ্র দেশই ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো বিনা যুদ্ধে।
আশ্চর্যের বিষয় এমন মানুষও আমাদের সমাজে কেন জানি তেমনভাবে নন্দিত হলেন না। তার কাছ থেকে পাওয়া সোনার খনি অনাবিষ্কৃতই থেকে গেল। এই মানুষটির জানার পরিধি ছিল ব্যাপক। আকবর আলি খানকে কোনো একটি পরিচয়ে সীমিত রাখা কঠিন। জীবনজুড়ে তার কর্ম ও ভাবনার যে ক্ষেত্র ছিল, তা এককথায় বর্ণনা করা সহজ নয়। তিনি একই সঙ্গে আমলা ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন, অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন, ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, গবেষণা করেছেন, আবার বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তার অন্তরালে যাবার কারণগুলো সবাই জানেন। যখনই কেউ সত্য বলে আর তা শাসক দলের বিরুদ্ধে যায় তখনই তাকে এমন অবস্থার শিকার হতে হয়। রাজনৈতিক অচলায়তন ও অর্থনৈতিক সংকট বা সম্ভাবনায় তার মতামত আপনি নেবেন কি নেবেন না সেটা আপনার বিষয়। কিন্তু যে মানুষটি ইতিহাসের ছাত্র হবার পরও অর্থনীতিতে ছিলেন অসাধারণ মেধাবী, অর্থনীতিতে কাজ করে দেখিয়ে গেছেন সঠিক পথ- তাকে কোনঠাসা করার কী মানে?
আপনি তার জীবন পর্যালোচনা করলে বা খতিয়ে দেখলেই জানবেন এমন দেশপ্রেমী মানুষ এখন বিরল। যারা পদ্মাসেতু নিয়ে তার একটি উক্তিকে পুঁজি করে নানা কথা তুলছেন তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন পদ্মা সেতুর এফেক্ট বা তার ভবিষ্যৎ তারা জানেন? এতো বড় একটি কাজ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সাহস ও শক্তির প্রমাণ দিয়েছেন তাকে আরো গতিশীল করার জন্য সবাই যার যার জায়গা থেকে হয়তো নিজেদের কথা বলেছেন। আকবর আলি খান কি চাইতেন যে এ সেতুটি না হোক? এই হচ্ছে আমাদের জাতীয় রোগ। দলান্ধতা আমাদের চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের দৃষ্টিশক্তি আজ নাই বললেই চলে। তার কারণেই আকবর আলি খানও সমালোচনার শিকার হন।
পোশাক শিল্প নিয়ে তার কথাগুলো পড়ে দেখুন: ‘পোশাকশিল্প মূলত বৈদেশিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল; কিন্তু পোশাকশিল্পের একটা বড় সংকট অদূর ভবিষ্যতে আসবে। সেটা হলো পোশাকশিল্পে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক সস্তায় নিজেদের মাপ অনুসারে পোশাক তৈরি করা সম্ভব। ইংরেজিতে এটাকে বলে ‘কাস্টোমাইজড ড্রেস’। এখন যে ধরনের পোশাক আমরা বিদেশে পাঠাচ্ছি, সেগুলো কতগুলো বড় মাপের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়, যেগুলো সবার গায়ে লাগে না। সবার গায়ে লাগে এমন পোশাক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উন্নত দেশে তৈরি করা সম্ভব। এর ফলে পোশাক খাতে যারা বিদেশে কারিগরি পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করতে পারবেন না, তারা বিপদের সামনে পড়বেন।’
কথাগুলো কি ভয় ধরিয়ে দেয়ার জন্য বলা না সাবধানতার জন্য বলা? একজন দূরদর্শি মানুষ তো এমনই বলেন। আমাদের সমাজ আজ দৃষ্টিশক্তি হারি্য়ে ফেলছে বলে এঁদের চিনতে পারছে না। আমাদের কণ্ঠ যেদিন রুদ্ধ হয়ে যাবে জি জি ছাড়া আর কিছুই বেরুবে না সেদিন আমরা খুঁজবো কোথায় আছেন আকবর আলি খান?
ব্যক্তিজীবনেও অসাধারণ ধীশক্তির অধিকারী মানুষটি স্ত্রী প্রাণপ্রিয় কন্যাকে হারিয়ে পাগল হয়ে যাননি। শোককে বুকে ধারণ করে শক্তি করে তোলার সাধনা করে গেছেন। দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসুক আর যাই হোক সমাজ ছুটছে অন্ধকারের অতলে। সাম্প্রদায়িকতা দলান্ধতা আর লোভের কবলে পড়ে কৃশ হয়ে পড়া এই সমাজকে বাঁচাতে তার মতো স্পষ্টবাদী মানুষের বিকল্প নাই। বাংলাদেশ মেধার দেশ। আকবর আলি খানের মতো মানুষ যেদিন জনগণের সামনে ভাস্বর হয়ে উঠবে সেদিন আমরা জানবো, নিরাপদ সমাজ খুব বেশি দূরে নাই আর।
আকবর আলি খান সুবক্তা, সু-অর্থনীতিবিদ, কলাম লেখক যার বইয়ের নাম ‘মিথ্যার দশ পা দেখা’। এমন সাহসী সেকুল্যার মানুষকে আনত প্রণাম। শেষ বিদায়ে শ্রদ্ধা জানাই তাকে। সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
এন