মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরি ভূমিকা প্রয়োজন
Share on:
দেশে মূল্যস্ফীতি প্রায় এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি এখন একটি চলমান সমস্যা হয়েছে। এটি হচ্ছে সময়মতো মূল্যস্ফীতি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার ফল।
সেই ব্যর্থতা ঘুঁচিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরি ভূমিকা প্রয়োজন। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ মূল্যস্ফীতির ওপর প্রাথমিক প্রভাব ফেলেছিল, এত দীর্ঘ সময়ের পরে এটি একটি বৈধ অজুহাত নয়। অন্যান্য কারণ, যেমন এ সময়ের মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির দুই দফাও মূল্যস্ফীতিতে অবদান রেখেছে। যেহেতু জ্বালানি তেল অর্থনীতির প্রায় সব খাতের জন্য অপরিহার্য, তাই এর দাম বাড়া বেশির ভাগ পণ্য ও পরিষেবার খরচকে প্রভাবিত করে।
ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কার মতো অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে যখন মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল, তখন তারা তাদের সুদের হার বেঁধে রাখেনি। তারা আরও বিচক্ষণতার সঙ্গে মুদ্রানীতি ব্যবহার করেছে এবং সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতির অধীন একটি সময়োপযোগী সুদের হারের ব্যবস্থা প্রবর্তনে পদক্ষেপ অপর্যাপ্ত ছিল। সুদের হারের সীমা অপসারণের পরও সাম্প্রতিক মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় অকার্যকর রয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতির জন্য শুধু সাপ্লাই সাইডকে দায়ী করে বসে থাকলে চলবে না। ডিম্যান্ড সাইড থেকেও কিছু করার আছে। কারণ বর্তমান মূল্যস্ফীতি যেমন শুধু সাপ্লাই সাইডের কারণে সৃষ্টি হয়নি তেমনি শুধু ডিম্যান্ড সাইডের কারণেও হয়নি। তাই সাপ্লাই সাইড এবং ডিম্যান্ড সাইড উভয় দিক বিবেচনায় রেখেই সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়ে মূল্যস্ফীতিতে অবদান রেখেছে, যা বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়িয়েছে। অধিকন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে ডলারের বিনিময় হারকে কৃত্রিমভাবে বেঁধে রাখা হিতে বিপরীত হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজস্বনীতির কার্যকর ব্যবহারের সুযোগ ছিল আমদানি পণ্যের ওপর বিভিন্ন কর ছাড় দিয়ে, অথচ তা সেভাবে দেখা যায়নি। তবে টাকার ২৫ থেকে ৩০ ভাগ অবমূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে একই সঙ্গে যখন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন সরকার অনেক আমদানি পণ্যের ওপর কর সমন্বয় করেনি। এ কারণে দেশীয় বাজারে অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই অভ্যন্তরীণ বাজারে আমদানি করা পণ্যের জন্য কর কমিয়ে এবং প্রয়োজনে কর অব্যাহতি প্রদানের মাধ্যমে একটি যুক্তিসংগত মূল্যস্তর বজায় রাখতে রাজস্বনীতি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়নি।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমার যদি বিরাজমান মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতির দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। ভারতের মূল্যস্ফীতি এখন ৪ শতাংশ। আর আমাদের মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার যদি বেশি হয়, তাহলে ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পাবে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার যদি নির্ধারণ করে রাখা হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি স্থানীয় মুদ্রায় তা কম পাচ্ছি। বিশ্বের অনেক দেশই তাদের পণ্য রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করার জন্য স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে প্রায়শই এমন অভিযোগ করে থাকে। ফলে রপ্তানিকারকগণ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে তার বিনিময়ে তুলনামূলক বেশি পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা পেয়ে থাকে। যে কোনোভাবেই হোক, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে অর্থনীতি স্থিতিশীল হবে।
এদিকে বাংলাদেশের বিপরীতে শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও, তা থেকে সেরে উঠছে। এর একটি প্রধান কারণ হলো, সংকটের সময় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীন ভূমিকা। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে সুদের হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার হার নিয়ন্ত্রণ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার, বিনিময় হার এবং সরকারি ঋণ-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে স্বাধীন নয়। তদুপরি, আগে যেমন আলোচনা করা হয়েছে, অনুপযুক্ত রাজস্বনীতি এবং দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনাও বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রেখেছে।
# ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কার মতো অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে যখন মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল, তখন তারা তাদের সুদের হার বেঁধে রাখেনি।
# আমাদের দেশে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।
ক্যাবের সভাপতি অর্থনীতিবিদ গোলাম রহমান বলেন, আমাদের দেশে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। কোভিডের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। কিন্তু পৃথিবীর অন্য দেশগুলো মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলেও আমরা পারিনি। বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে সরকার। আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। আশা করি, নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নেবে; বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে; সুদের হার স্বাধীন করতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ কমবে। এ ছাড়া এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ভোগ্যপণ্য দেওয়া হবে এবং পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা হবে।
সরকারের উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া ১. বাজারে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে সময়মতো খাদ্যপণ্য আমদানি করা। ২. বাজারে মুদ্রার জোগান কমাতে এবং মূল্যস্ফীতি রোধ করতে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার, বিশেষ করে সুদের হারের বাজারভিত্তিক সামঞ্জস্যকরণ। ৩. রাজস্বনীতির পুনর্মূল্যায়ন করা এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে আমদানি করা পণ্যের দাম কমাতে আমদানিতে কর হ্রাস করা। ৪. বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনা এবং যুক্তিহীনভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকারী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পণ্যের দাম বেড়ে গেলে স্বল্পতম সময়ে প্রতিযোগিতামূলক আমদানির অনুমতি দিয়ে বাজার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশ্বাসযোগ্য হুমকির ব্যবস্থা রাখা। ৫. কার্যকরভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ এবং ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ সম্পর্কে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। কী পরিমাণ পণ্য প্রয়োজন এবং কতটা আমদানি করতে হবে, তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছে থাকা উচিত। আমাদের মনে রাখা দরকার, মূল্যস্ফীতি কোনো একক সংস্থা বা নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর জন্য দরকার সুষ্ঠু মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বিত প্রচেষ্টা।
এদিকে ব্যাংক খাতের সংকট কাটাতে বছরজুড়েই প্রভাবশালীদের চাপে একের পর এক সিদ্ধান্ত বদল করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফ শর্তের পর কিছু আংশিক উদ্যোগ নিয়েছে, যার সব কটি বাস্তবায়িত হয়নি। ক্রমাগত বড় বড় ব্যাংকিং ঋণ কেলেঙ্কারি চলতে থাকলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়নি, বরং পর্যবেক্ষক সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এসবের অন্যতম উদ্দেশ্য ব্যাংক মালিক পরিচালক, ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীদের সম্পদ হস্তান্তর, সস্তায় ঋণ সরবরাহ। ধারণা করা হয়, এসব অর্থের উল্লেখযোগ্য পাচার হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের প্রধান তিন শাখার বৈদেশিক ঋণ কার্যক্রম ২৬ জুলাই ২০২৩ মঙ্গলবার বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চাপের মুখে এক দিন পর বুধবার সন্ধ্যায় ঋণ কার্যক্রম খুলে দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকটি নিয়ে সিদ্ধান্তটি ২৪ ঘণ্টাও ধরে রাখতে পারল না এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ব্যাংকটির ৭৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের অর্ধেকই এই তিন শাখায়, প্রভাবশালী গ্রাহকেরাও এখানে। এ সিদ্ধান্তে বেশি সময় স্থির থাকতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এনএইচ