tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
অর্থনীতি প্রকাশনার সময়: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৩০ পিএম

খেলাপির বদনাম কমাতে ১৮ হাজার কোটি টাকা অবলোপন


image-64913-1707631191

খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কাগজে-কলমে এ ধরনের ঋণ কমিয়ে দেখানোর প্রবণতা অব্যাহত রেখেছে। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে ঋণ অবলোপন বা হিসাব থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া সুবিধা ব্যবহার করে ব্যাংকের হিসাব থেকে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ‘উধাও’ করে দেওয়া হচ্ছে। তবে এ ধরনের পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঋণ দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণে ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ওপর মহলের চাপে ঋণ দিয়ে এখন সেই টাকা ব্যাংক আর আদায় করতে পারছে না। ব্যাংক খাত বাঁচাতে হলে এখন এ খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় ঋণখেলাপি, পুনঃতপশিল ও অবলোপনের মতো উচ্চ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বাড়তেই থাকবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রচলিত ঋণের খাতা থেকে এসব অর্থ মুছে ফেলছে ব্যাংক। মামলা করে, আমানতের সম্পত্তি নিলামে উঠিয়ে এবং সমঝোতাসহ নানা প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ব্যাংকগুলো এই ঋণ মুছে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। তবে বহু ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে রয়েছে অবহেলা এবং অনিয়মের অভিযোগ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ অবলোপন স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালে ছিল ১৮ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে এসব ব্যাংকের ঋণ অবলোপন বেড়েছে ২৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের অবলোপন করা ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬১১ কোটি টাকায়। এ ছাড়া জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার ২৪৫ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৪১ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৫৬৮ কোটি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ১ হাজার ৩২৭ কোটি এবং বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০০৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তা ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে তা আরও বাড়ল ২৭ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

তবে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। আইএমএফ নির্দেশিত পদ্ধতি অনুযায়ী হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি বা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ দুর্দশাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

করোনা মহামারির কারণে ব্যাংক ঋণ আদায়ে বিভিন্নভাবে ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সেসব ছাড় কোনো কাজে আসেনি বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। বিভিন্ন ছাড় দিয়েও যখন খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না, তখন পুরোনো কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে ব্যাংকগুলো। ঋণ অবলোপন করে খেলাপি কম দেখানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ কৌশলটির নাম ঋণ অবলোপন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। সেখানে কোনো ঋণ তিন বছরের পরিবর্তে দুই বছর ‘মন্দ মান’ হিসেবে খেলাপি হলেই তা অবলোপন করে ব্যাংকের ব্যালান্স শিট থেকে বাদ দেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করা হয়। এ উপায়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ কমানো হবে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম ছিল, ব্যাংকের মন্দমানের খেলাপি ঋণ তিন বছর ধরে আদায় না হলে তা ব্যাংকের মূল ব্যালান্স শিট থেকে আলাদা করে অন্য একটি লেজার বুকে সংরক্ষণ করা হয়। এর আগে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখা এবং অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা করতে হয়। ব্যাংকিং পরিভাষায় যা ঋণ অবলোপন বা রাইট অব নামে পরিচিত। এভাবেই ২০০৩ সাল থেকে ঋণ অবলোপন করে আসছে ব্যাংকগুলো।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পুনঃতপশিল, অবলোপন ও সুদ মওকুফ ব্যাংকিং খাতের খারাপ সংস্কৃতি। এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে খেলাপি ঋণের হিসাব কমবে, কিন্তু ব্যাংকের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে না। এখানে লুকোচুরি করা উচিত নয়, যা ঘটে তা-ই প্রকাশ করতে হবে। তাতে নীতিমালা কার্যকর হচ্ছে না, তা বোঝা যাবে।’

এসএম