খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা আটকে যাওয়ার নেপথ্যে কী?
Share on:
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক যুগ পর ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, যার মাধ্যমে প্রকাশ্য কোনো অনুষ্ঠানে তাকে দেখা গেল ছয় বছরেরও বেশি সময় পর। নানা রোগে অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসার দাবিতে রাজপথে টানা আন্দোলন করেছে বিএনপি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিএনপির অন্যতম বড় দাবি ছিল খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো। কিন্তু মুক্ত খালেদা জিয়া এতদিনেও কেন বিদেশে গেলেন না সে প্রশ্ন উঠেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাকে বিদেশ যেতে অনুমতি দেয়নি। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবার পর সাড়ে তিন মাস অতিবাহিত হলেও খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাননি। সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাত্রার স্বাস্থ্যগত দিক যেমন আছে তেমনি একটি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে বলেই আলোচনায় আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি কেবল স্বাস্থ্যগত বিষয় নয়। ‘তিনি তো এখন মুক্ত। সুতরাং তিনি যেকোনো সময় বাইরে যেতে পারেন। তিনি যদি বাইরে যেতে দেরি করেন বা না যান তাহলে বুঝতে হবে যে এর পেছনে কোনো না কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
বিএনপির তৃণমূল এবং দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকের চাওয়া হচ্ছে অনিবার্য না হলে খালেদা জিয়া দেশেই থাকুক। এর বড় কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচন হবে - অন্তর্বর্তী সরকারের এমন অবস্থানের কারণে বিএনপির অনেকের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে।
মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তার ভাষায় খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রার একটা 'ভিন্ন রাজনীতি' রয়েছে। ‘খালেদা জিয়াকে নিয়েই তো বিএনপির রাজনীতি। উনি যদি চোখের সামনে না থাকেন তাহলে বিএনপি অনেকটা দুর্বল হয়ে যাবে। যতদিন বেগম জিয়া দৃশ্যপটে আছেন ততদিন তিনিই কিন্তু বিএনপির রাজনীতির কেন্দ্র। সুতরাং তার প্রেজেন্সটা (উপস্থিতি) বিএনপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
‘সেজন্যই হয়তো তিনি ভাবছেন বা তার দল ভাবছে যে তিনি যাবেন কি যাবেন না। এটার মধ্যে রাজনীতি আছে। বিএনপির রাজনীতিতে খালেদা জিয়া এখন সবচাইতে বড় তুরুপের তাস মনে হচ্ছে আর কি। এই তাসটা তারা হারাতে চাইবে না,’ বলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
দল ও চিকিৎসক কী বলছে
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বিবিসিকে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে। বিদেশে দীর্ঘ যাত্রার জন্য খালেদা জিয়ার শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন বিষয় জড়িত এখানে। ‘ওনার মাল্টিপল কোমর্বিডিটিজ আছে তো। কাজেই সব জিনিস বিবেচনায় নিয়েই প্ল্যানিং করতে হয়। আমরা ইচ্ছা করলেই আমরা অন্য পেশেন্টের জন্য যা একটা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এনে তিন ঘণ্টায় সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক নিয়ে গেলাম আমাদের ইস্যুটাতো এরকম না।’
‘ইস্যুটা হচ্ছে টেকঅফ ল্যান্ডিং একটা নেগেটিভ প্রেসার মেইনটেনই করে সেটার মধ্যে সাসটেইন করা সবকিছু মিলিয়ে ডাক্তার সাহেবরা সবকিছু বিবেচনা করেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। খুব সহসাই শারীরিক অবস্থা যাওয়ার মতো হলেই ইনশাআল্লাহ আমরা আপনাদেরকে জানিয়েই যাব,’ বলেন জাহিদ হোসেন।
এদিকে দলীয় প্রধানের বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে সতর্ক বক্তব্য বিবৃতি দিতে দেখা যাচ্ছে। খালেদা জিয়ার জন্য বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে গিয়ে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে বলে জানান দলের মুখপাত্র এবং স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ।
‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার উদ্দেশে বিদেশ যাওয়ার সমস্ত আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে। তবে দূরপাল্লার যাওয়ার মতো এয়ার অ্যাম্ব্যুলেন্স সংগ্রহ করাটার জন্য কিছুদিন বিলম্ব হচ্ছে। আশা করি ইতিমধ্যে ব্যবস্থা হয়েছে এবং খুব শিগগিরই উনি যেতে পারবেন। প্রথমে তিনি যুক্তরাজ্যে যাবেন এবং সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পরে ওনার চিকিৎসক দলের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে,’ বলেন সালাউদ্দিন আহমেদ।
উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যেই খালেদা জিয়া বিদেশ যাবেন এবং সেজন্য সরকারি পর্যায় থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাবার ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক বিষয় নেই।
খালেদা জিয়া এবং ‘মাইনাস ফোর’
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাষ্ট্র সংস্কারের বড় দাবি রয়েছে আন্দোলনকারীদের। ২০০৭ সালে এক এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও রাজনীতিতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল। সে সময় আলোচিত হয়েছিল ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’।
এক এগারো সরকার নিয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তৎকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তা, সেনাপ্রধানসহ অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। এ সময় রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার বিষয়টি বিশেষভাবে জানার চেষ্টা করেছেন। তার 'এক এগারো' গ্রন্থে আলাদা একটি অধ্যায় রয়েছে ‘মাইনাস টু’ শিরোনামে।
মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসিকে বলেন, ‘যখন এক এগারো নিয়ে বই লিখি তখনতো আমি ব্রিগেডিয়ার বারী ও জেনারেল মইন এদের ইন্টারভিউ করেছিলাম। আমি একবার বারীকে (চৌধুরী ফজলুল বারী) প্রশ্ন করলাম, আপনারা ‘মাইনাস টু’ কেন চাচ্ছিলেন? তিনি বলেন যে, আমরা কখনো মাইনাস টু’র কথা বলি নাই, এটা মিডিয়ার সৃষ্টি। আমরা চেয়েছিলাম মাইনাস ফোর।’
‘মাইনাস টু’ বলতে প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেত্রীদের বোঝানো হয়। তবে ‘মাইনাস ফোর’ বাকি দুজন কারা সেটি পরিষ্কার না হলেও মহিউদ্দিন আহমদ ধারণা পান যে, বাকি দুজন হলেন দুই নেত্রীর পুত্র তারেক রহমান এবং সজীব ওয়াজেদ জয়। ‘এইটা আমাকে ওই সময় বলেছিল। যে তাদের চিন্তায় ছিল এটা। এবং আমি এটা বিশ্বাস করি। যে তারা চেয়েছিল যে দুইটা পরিবারের কবল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিটাকে মুক্ত করা। যারা এক এগারো করেছিলেন তাদেরতো একটা লক্ষ্য ছিল সেই লক্ষ্যটা ছিল হলো এই দুই পরিবারের হাত থেকে দেশটাকে মুক্ত করা,’ বলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
সম্প্রতি বিএনপির অন্যতম সিনিয়র নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্যে 'এক এগারো এবং মাইনাস টু' প্রসঙ্গটি এসেছে। এক এগারোর মতো বিরাজনীতিকরণের চক্রান্ত চলছে বলে বক্তব্য দিয়েছেন গয়েশ্বর রায়। এছাড়া বিএনপির মহাসচিব তার এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘কেউ যেন মাইনাস টু ফর্মুলার কথা না ভাবে।’
আবার মাইনাস ফর্মুলা আলোচিত হওয়া এবং এর সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার সম্পর্ক আছে কি না সেটি নিশ্চিত নয়। তবে মহিউদ্দিন আহমদের ধারণা মাইনাস ফর্মুলার একটা বিবেচনা থাকলেও থাকতে পারে। ‘ইতোমধ্যে ছাত্র জনতার আন্দোলনের অনেক মুখপাত্র বলেছেন যে তারা একটা ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটিয়ে আরেকটা গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় আনার জন্য এত ছেলে মরে নাই। সুতরাং মেসেজটাতো ক্লিয়ার। সবাই চাচ্ছে রাষ্ট্র মেরামত, সংস্কার। আর অন্তর্বর্তী সরকারের নেপথ্যে শক্তি হলো আন্দোলনকারী ছাত্ররা এবং সেনাবাহিনী।’
‘ফোরের মধ্যে মাইনাস ওয়ান হয়ে গেছে ২০০৮ এ। আর ৫ আগস্ট আরও দুজন হয়ে মাইনাস থ্রি কমপ্লিট। এখন যদি খালেদা জিয়া বিদেশে চলে যান তাহলে মাইনাস ফোর হয়ে যাবে। ওইটার ধারাবাহিকতায় আমার মনে হচ্ছে,’ বলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
'মাইনাস ফর্মুলার' বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন বিএনপির মুখপাত্র সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি মনে করেন, ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকারের সাথে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা চলে না। ‘আমি জানিনা কেউ এগুলো উচ্চারণ করে কি না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটা জনগণের সরকার। এটা গণঅভ্যুত্থান, গণবিল্পব গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জনগণের সরকার। সুতরাং এখানে মাইনাস ফর্মুলার কোনো অস্তিত্ব এখানে নেই। এই সরকার আমাদেরই সরকার। আমরা এই সরকারকে সহযোগিতা করি। এই সরকারকে ওউন করি,’ বলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। -বিবিসি বাংলা
এনএইচ