tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
জাতীয় প্রকাশনার সময়: ১৪ জানুয়ারী ২০২৩, ০৮:৪৮ এএম

বিশ্ব ইজতেমা : পাক-ভারত থেকে নিরাপদ পরিবেশ বাংলাদেশ


7

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তর পাশে টঙ্গীতে তুরাগ নদীর তীরে শীতকালে প্রতি বছর তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়।


সাধারণত ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে এই জমায়েত বাংলাদেশে হয়ে আসছে ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে - লাখ লাখ মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন, যাদের মধ্যে বিদেশীদের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো।

মুসলমানদের সবচেয়ে বৃহত্তম ধর্মীয় জমায়েত পবিত্র হজের পর বিশ্ব ইজতেমাকে বলা হয় মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় জমায়েত।

বিশ্ব ইজতেমা’র গোড়াপত্তন হয় ভারতে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ জমায়েত অর্ধশতকের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশে হয়ে আসছে।

বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, ১৯২৬ সালে মাওলানা হযরত ইলিয়াস (রহ.) ভারতের উত্তর প্রদেশের মেওয়াত এলাকায় তাবলীগী আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন এবং অঞ্চলভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমার আয়োজন করেন। কালক্রমে তাবলীগ সমগ্র উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করে এবং উপমহাদেশের বাইরেও এর প্রভাব পড়তে থাকে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সূত্র ধরে উপমহাদেশের ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান - এ তিনটি অঞ্চলে মুসলমানদের অবস্থান সাপেক্ষে তাবলীগের তিনটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক এবং লেখক এ কে এম খাদেমুল হক বলেন, ১৯২০ সালের দিকে যখন এটি শুরু হয়েছিল তখন এটা একটা আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল ভারতে।

তিনি আরও বলেন, একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা শুরু হয়েছিল। তখন হিন্দুদের মধ্যে একটা সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। হিন্দু ধর্ম থেকে যারা অন্য ধর্মে চলে যাচ্ছিল তাদেরকে আবারও হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেয়ার একটা চেষ্টা ভারতবর্ষে বিভিন্ন প্রদেশে শুরু হয়।

এটা একটা প্রক্রিয়া যেটাকে আন্দোলন বলা যায়। তখন মুসলমানদের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তখন দেওবন্দ কেন্দ্রীক মুসলমানেরা চিন্তা করলেন মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে আরও সচেতন করে তুলতে হবে।

এটাকে আন্দোলন বলা হয় এই অর্থে যখন একটা গোষ্ঠী অনেক লোক নিয়ে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত করে তখন সেটা আন্দোলনের রূপ নেয়।

খাদেমুল হক বলেন, যখন এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ শাসন করছে। তাবলীগ জামাত কখনোই নিজেদেরকে ব্রিটিশ বিরোধী হিসেবে প্রচার করতে চায়নি।

বিশ্ব ইজতেমার বাংলাদেশ পর্ব যেভাবে শুরু :

বাংলাদেশে চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে ইজতেমার সূত্রপাত হয়। চট্টগ্রামের সমুদ্রবন্দর দিয়ে হজে যাওয়ার জন্য মানুষ সেখানকার হজ ক্যাম্পে একত্রিত হতেন, আর আঞ্চলিক ইজতেমার প্রক্রিয়াটা সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল।

বাংলাদেশে তাবলীগ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইলিয়াসের ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ প্রথম তাবলীগের জামাত নিয়ে আসেন। ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারের কাজ করছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ।

ভারত এবং পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হওয়ার পর ইজতেমা আয়োজনের জন্য মোহাম্মদ ইউসুফ দুই দেশেই জামাত পাঠানো শুরু করলেন। তবে তখন ইজতেমা ছোট আকারে হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক ড. আব্দুর রশিদ বলেন, ১৯৪৬ সালে বাংলাদেশে ঢাকার রমনা পার্কের কাছে কাকরাইল মসজিদ- যেটা সে সময় মালওয়ালি মসজিদ নামে পরিচিত ছিল - সেখানে এই সম্মেলনটা হয়। এরপরে হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে।

স্বাধীন বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল, তখন ১৯৬৫ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে একটি জামাত আসে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মো: খান শাহাবুদ্দিন নাফিস। তখনকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খান শাহাবুদ্দিন নাফিস বর্তমানে তাবলীগ জামাতের শূরা কমিটির একজন উপদেষ্টা।

এখন যেভাবে বিদেশ থেকে বহু মুসলমান ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন, সেই সময়ে অবশ্য অন্যান্য দেশ থেকে লোকজন আসেনি বলে জানান খান শাহাবুদ্দিন নাফিস। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছিল, আর ছিল গ্রামের মানুষ,’ বলেন তিনি। ঢাকার পর মোহাম্মদ ইউসুফ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেন।

খান শাহাবুদ্দিন নাফিস আরও বলেন, তাবলীগের জমায়েতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে ইজতেমা হয় টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের কাছে। এর পরের বছর ঠিক করা হয় ইজতেমা হবে টঙ্গীর তুরাগ নদীর কাছে।

আরও পরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান টঙ্গীতেই ১৬০ একর জমি নির্ধারণ করে দেন ইজতেমার জন্য, জানান খান শাহাবুদ্দিন নাফিস।

বিশ্ব ইজতেমা নামকরণ কীভাবে হলো?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক ড. আব্দুর রশিদ বলছিলেন, ‘বিশ্ব ইজতেমা’ তাবলীগের দেয়া নাম নয়, বরং তাবলীগের লোকজন এটাকে বার্ষিক সম্মেলন বলতেন।

খান শাহাবুদ্দিন নাফিস জানান, তাবলীগ জামাতের পক্ষ থেকে বিদেশীদের পাঠানো শুরু হয় এক সময়। যখন বিদেশ থেকে লোক আসা শুরু করলো, তখন গ্রামের লোক এটাকে বিশ্ব ইজতেমা বলা শুরু করলো। শূরার একজন প্রবীণ ব্যক্তি বললেন, ‘জনগণের চাহিদার উপর আল্লাহ তায়ালা বিশ্ব ইজতেমা করে দিয়েছেন।’

‘বিশ্ব ইজতেমা’ নাম নিয়ে তাবলীগ জামাতের মধ্যেই শুরুতে বিতর্ক ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে বিশ্ব ইজতেমা নামটি প্রচলিত হয়ে যায়।

বাংলাদেশ কেন বিশ্ব ইজতেমার স্থান হিসেবে নির্ধারিত হল?

ভারতে ইজতেমার ধারণা শুরু হয়েছিল। ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে ইজতেমা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এটি ভারত, পাকিস্তান বা অন্য কোনো দেশে না হয়ে বাংলাদেশেই স্থায়ী হয়েছে।

খান শাহাবুদ্দিন নাফিস বলছিলেন, ‘এর একটা কারণ ছিল সে সময়ে বাংলাদেশের ভিসা পাওয়া সহজ ছিল। ইজতেমার নামে কেউ ভিসা আবেদন করলে কেউ ফেরত যেত না। এটা সরকারের একটা ভালো পলিসি ছিল।’

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার এই ইজতেমাকে সমর্থন করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির শিক্ষক এবং লেখক একেএম খাদেমুল হক বলেন যে দুটো কারণে বিশ্ব ইজতেমার স্থায়ী ঠিকানা বাংলাদেশে হয়েছে।

এক) বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ।

দুই) তাবলীগ জামাতের যে আন্দোলন সেটা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রীক।

যদিও ভারতে এর শুরু কিন্তু ভারতে মুসলিমপ্রধান দেশ না হওয়ার কারণে অনেক দেশের মুসলিমরা সেদেশে যেতে কমফোর্ট ফিল করেননি। আবার পাকিস্তানকে নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে।

তিনি আরও বলেন, তাবলীগের জমায়েত বাংলাদেশে শুরু থেকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যতটা পেয়েছে ততটা ভারত বা অন্য কোথাও পায়নি। এছাড়া সবচেয়ে কম খরচে মানুষ বাংলাদেশে আসতে পারতো।

গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা হওয়ার পিছনে কিছু রাজনৈতিক কারণও ছিল।

ঢাবি শিক্ষক ড. আব্দুর রশিদ বলেন, ভারতের কিছু স্থানে তখনো মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি মতবিরোধ ছিল। সে তুলনায় বাংলাদেশে মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল, যাকে একটা নিরাপদ পরিবেশ বলে মনে করেছিলেন তারা।

তবে তিনি এও বলেন যে, তাবলীগের এক সম্মেলনে ইজতেমার স্থান হিসেবে লটারির মাধ্যমে বাংলাদেশের উঠে আসে বলে অনেকে উল্লেখ করেন। অবশ্য এই তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলেও জানান তিনি।

ভারত এবং পাকিস্তান - এই দুটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তুলনামূলক নিরপেক্ষ একটা স্থান ছিল।

কারণ হিসেবে বলা হয়, রাজনৈতিক কারণে তখন ভারতের নাগরিকরা যেমন সহজে পাকিস্তানে যেতে পারতেন না, তেমনি পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য ভারতে পাওয়া ছিল কঠিন একটি বিষয়।

ফলে বাংলাদেশই ছিল ওই দেশ যেখানে সহজে সবাই আসা-যাওয়া করতে পারতেন বলে গবেষকরা মনে করেন।

তবে তাবলীগের ইজতেমা যে বিশ্বের অন্য কোথাও হচ্ছে না তা নয়। পাকিস্তানের রাইবেন্ড এবং ভারতের ভোপালে বড় আকারে ইজতেমা হয় বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমার ঠিক আগে ও পরে।

তবে যে সংখ্যায় বিদেশীরা বাংলাদেশের ইজতেমায় আসেন, তাতে করে তুরাগ তীরের ইজতেমাই ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সূত্র : বিবিসি বাংলা।

এন