আ’লীগের অপকর্মের দায় নিতে রাজি নয় ১৪ দলের শরিকরা
Share on:
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্মরণকালের মহাবিপর্যয় ঘটেছে দলটির।
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়া এবং দলটির সব পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রী ও এমপিদের আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরই দীর্ঘ দিন ধরে সুখে-দুখে পাশে থাকা জোটসঙ্গী দলগুলোও বোল পাল্টাতে শুরু করেছে। জোটসঙ্গী হিসেবে টানা ১৬ বছর সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও এখন আওয়ামী লীগের অতীতের কোনো অপকর্মের দায়ভার নিতেও রাজি নয় শরিকদলগুলো। যদিও গণহত্যার হুকুমদাতা হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের শরিক দলগুলোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত বুধবার একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়।
এ বিষয়টি নিয়ে জোটসঙ্গীরা বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন। অভিযোগ প্রাথমিক অবস্থায় থাকায় বিষয়টি আপাতত পর্যবেক্ষণ করছেন জোটের শরিকরা। তাদের মতে, জোটের প্রত্যেক দলের নিজস্ব গঠনতন্ত্র আছে। তাদের রাজনৈতিক আদর্শ আছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসের ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট গঠন হয়েছিল সেই ২০০৪ সালে। এরপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে টানা ১৬ বছর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেয়াদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জাপা, তরিকত ফেডারেশন অন্যতম। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ছিল জোট প্রধান। তাদের কথামতোই সব চলত। তারাই সরকারের সুযোগ-সুবিধাভোগী। এ দেশে যত লুটপাট, গুম, খুন, বিরোধী দল দমনসহ অন্যান্য যেসব অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে তা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই করেছে। শরিকদলগুলো শুধু জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনের সময় সক্রিয় ছিল। ফলে তাদের অতীতের অপকর্মের দায়ভার শরিকরা কেন নেবে- তাদের এমন প্রশ্নও রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আলাপ হয় জোটের অন্যতম শরিক ন্যাপের সহসাধারণ সম্পাদক মো: ইসমাইল হোসেনের সাথে। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগ জোটের কার্যকারিতা আসলে নেই। জোট প্রধান দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ কেউ এরইমধ্যে গোপনে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুধু নয়, অতীতে সব ধরনের গুম-খুন, হত্যার বিষয়ে আমরা সোচ্চার ছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা কারো কথা শোনেননি। শিক্ষার্থীদের হত্যার ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকার দায়ি। এক প্রশ্নের জবাবে মো: ইসমাইল হোসেন বলেন, ৫ আগস্টের আগে আন্দোলন দমানোর জন্য আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত নিষিদ্ধ করতে হবে এবং কারফিউ জারি করতে হবে। ওই সভায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু উপস্থিত ছিলেন। আমাদের কাউকে ডাকা হয়নি। আমরা সরকারেও ছিলাম না। অতএব আওয়ামী লীগের এসব অপকর্মের দায়ভার আমরা নেবো না।
সাম্যবাদী দলের সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়ার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেলেও কথা হয় কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ডা: ওয়াজেদুল ইসলামের সাথে। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা সব সময় গুম খুন হত্যার বিপক্ষে ছিলাম। সব সময় জোটের মিটিংয়ে বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেখ হাসিনা কারো কথায় শোনেননি। তার পরও জোটগতভাবে হলেও কিছু কিছু বিষয় দ্বিমত থাকার পরেও বাধ্য হয়ে সমর্থন দিতে হয়েছে। তাই আমি মনে করি, যারা সরকারে ছিল দায়ভার তাদের সবার ওপরই বর্তায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগ জোটের আরেক শরিক গণতন্ত্রী পার্টির সাবেক এক সাধারণ সম্পাদক বলেন, শেখ হাসিনা কৌশলে ১৪ দলের কোমর একেবারে ভেঙে দিয়েছেন। ১৪ দল ভেঙে এখন ২৮ দলে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ঢালাওভাবে ১৪ দলকে দায়ী করা ঠিক হবে না।
জোটের মধ্যে যেসব দল আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ছিলেন কেবল তারাই দায়ভার নেবেন। অন্যরা তো আওয়ামী লীগের অপকর্মের দায় নিতে পারে না। তার ওই বক্তব্যের দ্বিমত পোষণ করে ভিন্ন সুরে কথা বলছেন জাসদের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম। তিনি স্বীকার করেন, হত্যা, খুন-গুম, লুটপাট, চাঁদাবাজিসহ সব অপকর্মে আওয়ামী লীগ জোটের শরিকদের দায়ভার অবশ্যই আছে। এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরে আমরা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিতে বলেছিলাম। ভোটের ক্ষেত্রে দেশের মানুষের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা কোনোটার বাস্তবায়ন করেননি। বরং আদর্শিক রাজনীতি শেখ হাসিনা নির্মূল করে দিয়েছেন। শহীদুল ইসলাম বলেন, ছোট ছোট দলগুলোর ক্ষমতার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর বিরোধীদলীয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দলীয় জোটের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ১১ দল মিলে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। তবে, জোট গঠনের পর পরই ১১ দল ভেঙে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) কয়েকটি দল বেরিয়ে যায়। রয়ে যায় ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণফোরামসহ কয়েকটি দল। তবুও জোটটি ১৪ দল নামেই পরিচিত। ২০০৭ সালে জোট থেকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম বেরিয়ে যায়। পরের বছর ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ও নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন জোটে যোগ দেয়। ২০১৩ সালে ও ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টি (জাপা) জোট ত্যাগ করে। ২০১৬ সালে ইনুর জাসদ বিভক্ত হয়ে গেলে বাদল-আম্বিয়া নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ জোট ত্যাগ করে। এখন সাম্যবাদী দল, বাসদ-রেজাউর, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণ-আজাদী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটে আছে ১২টি দল।
এফএইচ