২৮শে অক্টোবর অপ্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করেছে পুলিশ, রাজবন্দিদের মুক্তি দাবি
Share on:
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, ২৮শে অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ চলাকালে অপ্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করেছে বলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এতে আরও বলা হয়েছে, যদিও সব পক্ষই সহিংসতা করেছে, তবু রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর পুলিশের অব্যাহত দমনপীড়নের কারণে এসব ঘটনা ঘটেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে। আজ ১লা নভেম্বর নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে তারা এসব কথা বলেছে।
নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতা এবং তার প্রেক্ষিতে পরবর্তী চলমান সহিংসতায় কমপক্ষে ১১ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে আছেন পুলিশ সদস্যও। আহত হয়েছেন কয়েকশত মানুষ।
এতে আরও বলা হয়, সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে আন্তর্জাতিক আহ্বান এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেয়া নিজেদের প্রতিশ্রুতি উপক্ষো করে চলছে বাংলাদেশ সরকার। আগামী জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেছেন, ‘অনেক বাংলাদেশি বলেছেন যে, তারা সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন। কারণ, নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ভোটকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালাচ্ছে সরকার। বিরোধীদের টার্গেট করায়, হয়রান করায় এবং তাদেরকে যখন জেলে রাখা হবে, তখন বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে জোর দিয়ে বলা উচিত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের’।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী দলের কয়েক হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।
তাদের দলীয় অফিস তালাবদ্ধ করেছে। সরকার গত বছর থেকেই খেয়ালখুশি মতো গণগ্রেপ্তার বৃদ্ধি করেছে। দৃশ্যত নির্বাচনকে সামনে রেখে একে বিরোধীদের দমন করার একটি সমন্বিত চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। ২৮শে অক্টোবরের সংঘর্ষের সময় আওয়ামী লিগ ও বিএনপির সমর্থকরা উভয়েই সহিংসতায় যুক্ত হয়েছেন। এতে কয়েক ডজন সাংবাদিকসহ কয়েক শত মানুষ আহত হয়েছেন। উভয় দলই সহিংসতায় নিজেদের জড়িত থাকার অভিযোগ্য প্রত্যাখ্যান করেছে। কর্তৃপক্ষ যখন সহিংসতার জন্য বিএনপিকে দায়ী করছে, তখন বিএনপি সহিংসতা উস্কে দিতে এবং তাদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে সমাবেশে সরকার সমর্থকদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ করেছে।
তারা দাবি করেছে, তাদের সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। এর প্রেক্ষিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, শান্তিপূর্ণভাবে সমর্থকদের প্রচারণা চালানোর জন্য আহ্বান জানানো উচিত রাজনৈতিক নেতাদের।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকে সব রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি বলা হয়েছে এটা নিশ্চিত করতে যে- এরকম সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় এবং এমন কোনো বক্তব্য বা কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে, যা সহিংসতায় উস্কানি দেয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ওই সহিংসতার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তারা বলেছেন, মহাসমাবেশে পুলিশ অতিরিক্ত রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। সরকারের উচিত নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সহিংস বিক্ষোভের জবাবে জাতিসংঘের ‘বেসিক প্রিন্সিপাল অন দ্য ইউজ অব ফোর্স অ্যান্ড ফায়ারআর্মস বাই ল এনফোর্সমেন্ট অফিসিয়ালস’ মেনে চলতে প্রকাশ্যে নির্দেশ দেয়া।
বিএনপি'র মহাসমাবেশকে সামনে রেখে তাদের কমপক্ষে ১৫০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, দলীয় সদস্যদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকার চারপাশে চেকপয়েন্ট বসায় পুলিশ। উদ্দেশ্য, ২৮শে অক্টোবরের মহাসমাবেশে অংশ নিতে আসা বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা।
বিরোধী দলের মতে, জুলাইয়ে একই রকম সমাবেশের সময় থেকে প্রায় ৫০০০ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকে নতুন নতুন মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। ২৬শে অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভি বলেছেন, আমাদের দলীয় নেতাকর্মীতে জেলখানা উপচে পড়ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও লিখেছে- গণগ্রেপ্তারে এটাই মনে হয় যে, বিরোধী দলীয় নেতাদের পর্যায়ক্রমিকভাবে গ্রেপ্তার ও অভিযুক্ত করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ আছে। তারা এটা এ জন্য করছে, যাতে জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দলীয় এসব সদস্যকে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অযোগ্য করা যায়। বিচারও দৃশ্যত এই চেষ্টায় রাতেও চলছে।
বিএনপির মতে, এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ জনকে এরই মধ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আটক রাখা কিছু বন্দি বলেছেন, তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি মিডিয়ার কাছে বলেছেন, তাকে আটক করে প্রহার করেছে পুলিশ। এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মিথ্যা কথা বলেছেন অ্যানি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আটক অবস্থায় সব নির্যাতন ও অন্যান্য অবমাননার পূর্ণাঙ্গ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। এতে যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, এক দশক আগে পাস হয়েছে ‘টর্চার অ্যান্ড কাস্টডিয়াল ডেথ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট’। তারপর এর অধীনে এ পর্যন্ত একটিমাত্র নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সরকারকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক টিম পাঠাবে না। এ সিদ্ধান্ত এই সত্য প্রতিফলিত করে যে, বর্তমান সময়ে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করা হয়েছে এটা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের বিষয়ে সেপ্টেম্বরে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট। ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ প্রোগ্রামের অধীনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাণিজ্যিক সুবিধার বৈধতা নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলে। বিরোধীদের টার্গেট করে গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্তকে বাধাগ্রস্ত করে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যেসব ব্যক্তি দায়ী হবেন বা জড়িত থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে। মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ নির্বাচনে নিয়ম লঙ্ঘন করে, তাই আন্তর্জাতিক অংশীদারদের পরিষ্কার করা উচিত যে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা অব্যাহত রাখবে না। তাদের উচিত বিরোধীদের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার ও তাদেরকে টার্গেট করার নিন্দা জানানো। একই সঙ্গে বাংলাদেশ তার নিয়ম লঙ্ঘন থেকে ফিরতে ব্যর্থ হলে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে পরিণতি ভোগ করতে হবে।
এনএইচ