লক্ষ্য ২০৪০ সাল : পাড়া-মহল্লায়ও চলবে বৈদ্যুতিক গাড়ি
Share on:
দেশে ইঞ্জিনবিহীন ইলেকট্রিক ভেহিকল (ইভি) বা বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ির সীমিত ব্যবহার এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। তবে এ সংখ্যা অর্ধশতাধিকের বেশি নয়; যার বেশির ভাগই ব্যবহৃত হচ্ছে ঢাকায়।
উল্টো দিকে পরিবেশের সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বব্যাপী এখন এই ইভির ব্যবহার জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, উন্নত দেশের কোনো কোনো শহরের কোনো একটি এলাকাতেই ইভির চলাচল সহস্রাধিক ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে এখনো যোজন যোজন দূরে বাংলাদেশ। আর এখানেই ভবিষ্যতের বড় সম্ভাবনা দেখছেন সরকারের নীতিনির্ধারক ও খাতসংশ্লিষ্ট বেসরকারি উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হালনাগাদ তথ্য বলছে, দেশে ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৩৮টি নিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে; যার ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগের বেশি হলো জ্বালানি তেলনির্ভর ইঞ্জিনচালিত গাড়ি। অপর দিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, প্রতিবছর গড়ে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি ব্যবহার হয় দেশে; যার ৯০ ভাগই আমদানি হয়ে থাকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার জ্বালানি তেল আমদানি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চাহিদাকৃত এ জ্বালানির অর্ধেকই ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন সচল রাখার কাজে। সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ানো ইঞ্জিনচালিত এসব যানবাহন নির্বিচার কার্বন নিঃসরণ ঘটাচ্ছে; যা জলবায়ুগত পরিবর্তন ত্বরান্বিত করছে এবং উষ্ণতাকে উসকে দিচ্ছে।
এর বিপরীতে যেসব গাড়ি শুধু বৈদ্যুতিক বা ব্যাটারির শক্তিতে পরিচালিত হয়, সেসব গাড়িকে ইলেকট্রিক গাড়ি বা ইভি গাড়ি বলে। অন্যান্য গাড়ির মতো এসব গাড়িতে জটিল পার্টসের সমাহার থাকে না, শুধু বডির সঙ্গে এক সেট ব্যাটারি ও একটি মোটর থাকে। এগুলো ঐতিহ্যবাহী গাড়ির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম ধোঁয়া নির্গমন করে, যা কম দূষণ এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে সহায়তা করে।
এমন বাস্তবতার মুখে প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হিসেবে বাংলাদেশও এখন জ্বালানি তেলনির্ভর ইঞ্জিনচালিত গাড়ির বিকল্প ভাবছে। এ লক্ষ্যে সরকার ইলেকট্রিক ভেহিকল বা ইঞ্জিনবিহীন বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি ব্যবহারকে উৎসাহিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যে এ-সংক্রান্ত নীতিমালাও প্রায় চূড়ান্তের পথে।
ওই নীতিমালার খসড়া তথ্যের মোদ্দাকথা হলো—সরকার চায় দেশে পরিবেশবান্ধব ইভির ব্যবহার বাড়াতে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি প্রাথমিকভাবে এ ধরনের গাড়ি আমদানিকে উৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। ইভি ব্যবহার নির্বিঘ্ন করতে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্তের মাধ্যমে সারা দেশে প্রয়োজনীয় চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হবে। প্রচলিত ধারার যানবাহনগুলোকে পর্যায়ক্রমে ইলেকট্রিক ভেহিকলে রূপান্তর করা হবে।
এর পাশাপাশি নীতি সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে দেশেই যাতে ইভি ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ ঘটে, সরকার তার পরিবেশও নিশ্চিত করবে। এভাবে সরকার ২০৪০ সালের পর দেশের পাড়া-মহল্লায়ও ইভির আধিক্য দেখার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে; যার উদ্দেশ্যেই হলো পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত এবং আমদানিজনিত ওই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়।
সরকারের এ পরিকল্পনাকে যুগান্তকারী হিসেবেই দেখছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলেন, ‘কেননা বিশ্বজুড়ে যেভাবে বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে ২০৪০ সালে যত গাড়ি বিক্রি হবে, তার সবই হবে বিদ্যুৎ-চালিত। সেই তুলনায় আমরা যেহেতু পিছিয়ে, তাই ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে যাতে ওই মার্কেটের বড় একটা আমদানি অংশীদার বাংলাদেশ হতে পারে, তার পথ আগে থেকেই সুগম রাখতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, সরকার বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটাই সম্ভাবনার পরবর্তী ধাপকে এগিয়ে নেবে।’
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান সরকারের পরিকল্পনা জানিয়ে বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ গাড়ি আমদানি হতে পারে, যার ৩০ শতাংশই হবে বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি। বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে এবং পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকার সেই পথ তৈরি করে দেবে।
এদিকে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোয় এখন যে কটি বৈদ্যুতিক গাড়ি চলছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্বখ্যাত টেসলা, অডি, পোরশে ও মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের ইভি কার। এর বিপরীতে ঢাকায় ইতিমধ্যে তিনটি ইভি চার্জিং স্টেশন স্থাপিত হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এ সংখ্যা ৩০টি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তথ্যমতে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এরই মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ইভি কার নির্মাণে কারখানা স্থাপন করেছে। বিশ্বখ্যাত বিওয়াইডির পরিবেশক হয়ে বাংলাদেশেও ইভি বাজারজাত শুরু করেছে রানার গ্রুপ। ইতিমধ্যে রাজধানীর তিব্বত এলাকার শোরুমে তারা বিওয়াইডি সিল ও বিওয়াইডি অ্যাটো-৩ নামক দুটি মডেলের বাজারজাতে কাজ করছে। আরও একটি মডেল তারা খুব দ্রুতই বাজারজাতের ঘোষণা দেবে।
ইঞ্জিনচালিত গাড়ির পরিবর্তে ইভির ব্যবহারে কোথায় কী ধরনের সুবিধা রয়েছে, জানতে চাইলে রানার গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) আমিদ সাকিফ খান জানান, ‘ইভি পরিবেশবান্ধব। গ্রাহকদের জন্য বেশ সুবিধাজনক। যাদের গাড়ি চড়ার সময় অতিরিক্ত শব্দ ও কম্পন পছন্দ নয়, তাদের জন্য ইভি সেরা একটি বিকল্প। কেননা ইভিতে শব্দ ও কম্পন হয় অতি সামান্য এবং এ গাড়ি কোনো কার্বন নিঃসরণ করে না।
আরেকটি সুবিধা হলো—আপনি বাসায় বসে চার্জ দিতে পারবেন, স্টেশনে যাওয়ার দরকার নেই। তার ওপর ইভিতে গ্রাহকের খরচ অনেক কম। ইভির ক্রয়মূল্য একটু বেশি হলেও এর অপারেশনাল খরচ এবং মেইনটেন্যান্স খরচ নেই। বাংলাদেশে, পেট্রলচালিত গাড়িতে আপনার প্রতি কিলোমিটার যাত্রায় প্রায় ২৫ থেকে ২৬ টাকা খরচ হবে। কিন্তু ইভিতে খরচ হবে ১ থেকে ২ টাকা, বেশি হলে ৩ টাকা। ইঞ্জিন ওয়েল চেঞ্জ করানো, সার্ভিসিং করানো—এ ধরনের কোনো ঝামেলা ইভিতে নেই।’
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ইউবিএসও বলছে, বিশ্বে বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ির বিক্রি ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। এই বাস্তবতায় এরই মধ্যে জাপানের টয়োটা মোটর করপোরেশন, জার্মানির ভক্সওয়াগন, যুক্তরাজ্যের জাগুয়ার, যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরস, ফোর্ড মোটরের মতো বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি তৈরির ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ইভি নিবন্ধন ও পরিবহন নীতি প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ গাড়িকে ইভি গাড়িতে রূপান্তরের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
এমএইচ