গত শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে জনপ্রশাসন সংস্কারসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে গত বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেন কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী।
মতামতে উঠে এসেছে, স্বাস্থ্যখাতে সরকারি সেবায় প্রায় শতভাগ গ্রহীতা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ৪৬ ভাগ বলেছেন নিম্নমানের সেবা পেয়েছেন। ১২ শতাংশ জানিয়েছেন তারা ওষুধ পাননি। তহশিল, ভূমি, সাবরেজিস্ট্রার ও সেটেলমেন্ট অফিসের সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৪২ শতাংশ জানিয়েছেন, সেবা পেতে তাদের ঘুস দিতে হয়েছে।
এদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন পরিচালিত জরিপের তথ্য বলছে, ৬৬ শতাংশের বেশি মনে করেন সরকারি কর্মচারীরা নাগরিকদের সঙ্গে শাসকের মতো আচরণ করেন। এর মধ্যে ৩১ শতাংশ অসৌজন্যমূলক আচরণ করার কথা বলেছেন। আর ৫২ শতাংশের মতে, ঘুস ছাড়া সেবা পাওয়া যায় না এবং ৪৬ শতাংশের মতে, তারা সেবা চাইতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে জরিপের এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জনপ্রশাসন সংস্কার–সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে নাগরিকদের মতামত নিতে অনলাইনে এ জরিপ পরিচালনা করেন তারা। এক লাখ পাঁচ হাজার নাগরিক বিভিন্ন প্রশ্ন সম্পর্কে তাদের মতামত দেন। নির্ধারিত প্রশ্নের বাইরে উন্মুক্তভাবে মতামত দেওয়ারও সুযোগ রাখা হয়।
জরিপের তথ্য বলছে, ৮৪ শতাংশের বেশি নাগরিক মনে করেন, দেশের জনপ্রশাসনে সংস্কার প্রয়োজন। ৮০ শতাংশের মত, দেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থা জনবান্ধব নয়। প্রায় ৬৯ শতাংশ নাগরিকের ধারণা, বিগত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে নিরপেক্ষতার অভাব ছিল। ৫৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, জনপ্রশাসনকে জনবান্ধব করার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ৪২ শতাংশের মতে, দুর্নীতিই হচ্ছে প্রধান বাধা।
জরিপে অংশ নেওয়া ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রধান কাজ জবাবদিহি নিশ্চিত করা। আর ৩৬ শতাংশের মতে, দুর্নীতি দূর করতে পারা হচ্ছে আসল কাজ। আর ৯৬ শতাংশ নাগরিকের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে।
এদিকে জনপ্রশাসন কমিশন তার সুপারিশে অধ্যাদেশ জারি করে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রশাসনিক ন্যায়পাল নিয়োগের সুপারিশ করেছে।
সংস্কার কমিশন তার প্রতিবেদনে বলেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনপ্রশাসনে চরম রাজনীতিকীকরণ ঘটেছে। ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেছে এবং কিছু কর্মকর্তাও ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছেন। কোনো সার্ভিস কল্যাণ সমিতি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। এর ফলে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মেধার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে এবং জবাবদিহিতাও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর সংখ্যা ৩৫ জনে সীমিত করার সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনে ২৩ জন মন্ত্রী রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে দু’জন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। এ ছাড়া ১২ জন প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী রাখার কথা বলা হয়েছে।
কমিশন সচিব ও সমপদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা ৬০ জনে সীমিত করার সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সংখ্যা এখনকার মতো একজনই রাখতে বলা হয়েছে। তবে মুখ্য সচিবের পদ ১৭টি করতে বলা হয়েছে। একাধিক বিভাগ থাকা মন্ত্রণালয়ে মুখ্য সচিব থাকবেন। বর্তমানে মুখ্য সচিবের একটি পদ। এ বিষয়ে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়গুলো পুনর্বিন্যস্ত করা হলে একাধিক বিভাগ সৃষ্টি হবে। যেসব মন্ত্রণালয়ে একাধিক বিভাগ থাকবে, সেগুলোতে সচিবের পাশাপাশি একজন মুখ্য সচিব নিয়োগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বর্তমান ‘সিনিয়র সচিব’ পদ বাদ দিতে বলেছে কমিশন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন জনপ্রশাসন ও শাসনকাঠামোয় বড় রকমের পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। পুরোনো চারটি বিভাগ নিয়ে আলাদা চারটি প্রদেশ এবং ঢাকা ও আশপাশের এলাকা নিয়ে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট বা রাজধানী মহানগর সরকার’ করতে বলেছে কমিশন। এ ছাড়া ৪৩টি মন্ত্রণালয় থেকে কমিয়ে ২৫টি (রাষ্ট্রপতির সচিবালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ ২৭টি) এবং মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে মোট সংখ্যা ৪৫টি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়গুলো কমানোর পাশাপাশি কোন মন্ত্রণালয় কাদের সঙ্গে একীভূত হবে, সে সুপারিশও করেছে কমিশন। রাষ্ট্রপতির সচিবালয় এখনকার মতোই আপন বিভাগ ও জনবিভাগ নিয়ে চলবে। এই দুই বিভাগের জন্য একজন মুখ্য সচিব থাকবেন।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন আছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিশনের প্রস্তাবে কেবল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রাখার কথা বলা হয়েছে। আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ একীভূত হবে। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। এ মন্ত্রণালয়ে মুখ্য সচিব এবং সামরিক সচিব রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও প্রধানমন্ত্রীর হাতে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিমন্ত্রী থাকবেন, আর সচিব থাকবেন একজন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে এখনকার মতো তিনটি বিভাগ (অর্থ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) থাকবে। এখানে একজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী রাখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি একজন মুখ্য অর্থসচিব এবং তিনজন সচিব রাখার কথা বলেছে কমিশন।
শিল্প, বাণিজ্য এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় করার প্রস্তাব করেছে কমিশন। সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলওয়ে মন্ত্রণালয়কে এক করে আগের মতো যোগাযোগ মন্ত্রণালয়; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একীভূত করার সুপারিশ করেছে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা, মাদরাসা ও কারিগরি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ বিভাগ নামে আলাদা তিনটি বিভাগ থাকবে।
তথ্য মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগকে একীভূত করে তথ্য মন্ত্রণালয় ও ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়; আইসিটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে বিজ্ঞান ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়; কৃষি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে কৃষি মন্ত্রণালয়; ভূমি, পানি সম্পদ এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে ভূমি, পানি, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়; খাদ্য এবং ত্রাণ ও দুর্যোগকে একীভূত করে খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়; সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু এবং মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে মুক্তিযুদ্ধ, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়; শ্রম ও জনশক্তি এবং প্রবাসী কল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; যুব ও ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় করার সুপারিশ করেছে। এছাড়া মন্ত্রণালয়গুলোকে ৫টি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিদ্যামান ক্যাডার সার্ভিস পুনর্গঠন করে ১৪টি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রশাসনিক বিভাগের জেলা পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন সময় জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে আটটি প্রশাসনিক বিভাগ সৃষ্টি হয়েছিল। কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার দাবি অনেক দিনের। এক্ষেত্রে কমিশন ভৌগোলিক ও যাতায়াতের বিবেচনায় কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি বিভাগ গঠন করা যেতে পারে বলে প্রস্তাব দিয়েছে।
বর্তমানে সারা দেশে আটটি প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে। বিদ্যমান আট বিভাগের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধীন জেলাগুলো পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, ছয় জেলা—নরসিংদী, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা নিয়ে ঢাকা বিভাগের এলাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে এ বিভাগে ১৩টি জেলা রয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি জেলা। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তা কমিয়ে পাঁচটি জেলার প্রস্তাব করেছে। এ পাঁচটি জেলা হলো
খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার।
এ ছাড়া বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের (এসিআর) পরিবর্তে বার্ষিক কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন (এপিই) পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেছে। কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে বাজেট বৃদ্ধিসহ বিশেষ সুবিধা প্রদানের সুপারিশ করেছে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভোট জালিয়াতি, অর্থ পাচার, দুর্নীতি এবং ২০২৪ সালের জুলাই আগস্ট গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে।
এমএম