বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আজকে বাংলাদেশ একটি অঙ্গীকারে আবদ্ধ। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেই বাংলাদেশে কোনো ধরনের জুলুম হবে না, শোষণ হবে না, নিপীড়ন হবে না। নতুন কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম নিবে না। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না, যেখানে আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হবো না, যেখানে দুর্নীতির দুর্গন্ধও থাকবে না। ঘুষের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে কোনো নাগরিক কাঁদবে না। বিচারের বাণী আর নিভৃতে কাঁদবে না, বিচার না পেয়ে কেউ আত্মহত্যা করবে না। সেই চিত্র আর আমরা বাংলাদেশে দেখতে চাই না। এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে দল-ধর্মের অধিকারের ব্যাপারে কোনো ব্যবধান থাকবে না। দেশের প্রতিটি নাগরিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।
শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) সকালে ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজ ময়দানে মহানগরী জামায়াত আয়োজিত বিশাল কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান এসব কথা বলেন।
মহানগরী আমীর কামরুল আহসান এমরুলের সভাপতিত্বে এবং সেক্রেটারি শহীদুল্লাহ কায়সারের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এড. মতিউর রহমান আকন্দ।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা বাংলাদেশকে আল্লাহর বিধান এবং সুন্নাহর ভিত্তিতে দেখতে চাই। নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. প্রতিষ্ঠিত মদিনার নগর রাষ্ট্রটি ছিল লিখিত সংবিধানের ভিত্তিতে দুনিয়ার প্রথম আধুনিক রাষ্ট্র। এর আগে দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রের লিখিত সংবিধান ছিল না। মদিনা কেন্দ্রিক নগররাষ্ট্র থেকেই দুনিয়ার প্রথম লিখিত সংবিধানের জন্ম। এখান থেকেই হিউম্যান চার্টার্ড তৈরি হয়েছে এবং এটাকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দুনিয়ার কোনো মতবাদের নেই। মদিনার এই সনদের মাধ্যমেই সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, জাতির সাথে বেঈমানী করলে সে যেই ধর্মের লোকই হোক তাকে শাস্তি পেতেই হবে। বিশ্বাসঘাতকদের দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রই ক্ষমা করে না। কারণ এটা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। মূল সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘হে নবী, আপনি দুনিয়ার মানুষকে জানিয়ে দিন, তিনিই (আল্লাহ) হচ্ছেন দুনিয়ার সকল বাদশাহর মালিক। আসমান-জমিনের একক কর্তৃত্ব একমাত্র তারই।’
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে তারা ধরে নিয়েছিলেন এবং তাদের অহংকারে আমাদের মনে হয়েছিল তারা কিয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। তারা দেশের মজলুম মানুষকে নিয়ে উপহাস করতেন। তারা দেশপ্রেমিক লোকদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে উল্লাস প্রকাশ করেছেন, মিষ্টি বিতরণ করেছেন। তবে তারা আল্লাহর সঠিক বিচার পেয়েছেন।
তিনি ময়মনসিংহবাসীদের আশ্বস্ত করে বলেন, আল্লাহর মানবিক বিধান কায়েমে আমরা সকলে এক। আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের আল্লাহ এক, নবী এক। আমাদের জীবন বিধান এক। তার ভিত্তিতেই ঐক্যের বাংলাদেশ গড়ব ইনশআল্লাহ। এতে কোনো বাধা-বিপত্তি মানব না। কোনো বাধার মুখে থেমে যাব না।
তিনি বলেন, আমরা কোনো অন্যায়ের সাথে আপস করব না। আমাদের একমাত্র ভরসা আল্লাহর ওপর। সুতরাং আমরা ভয় করব একমাত্র আল্লাহকে। আমি বলতে চাই, কেউ যেন আমাদের দিকে চোখ তুলে না তাকায়। যুগে যুগে নবী-রাসূল আলাইহিস সাল্লামগণ এবং তাদের অনুসারীগণ অসত্যের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছেন, তবু কারো কাছে মাথা নত করেননি। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন। ঐক্যের শক্তিতেই বিজয় আসবে ইনশাআল্লাহ। কোনো ব্যক্তি বা দলকে ক্ষমতায় বসানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য।

তিনি বলেন, দেশের জনগণের মাধ্যমেই আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে। সোনার দেশ গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। এজন্য আল্লাহকে ভয় করতে হবে। আল্লাহর ভয়ে যে হৃদয় সিক্ত, সে কারো জীবন, সম্পদ, ইজ্জত ও সম্মানের ওপর হাত দিতে পারে না। বরং সে অন্যের পাহারাদার হয়ে যায়।
তিনি বলেন, সমাজের প্রভাবশালীদের জন্য বিচার এক ধরনের, আর সাধারণ মানুষের জন্য আরেক ধরনের; সেটি চলতে দেওয়া যাবে না, সেটি বর্তমানে অচল। প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী অপরাধী হলে তারাও পার পাবেন না। ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হয় এরা ক্ষমতায় গেলে দেশ পঙ্গু হয়ে যাবে। কারণ দেশের দুর্নীতিবাজদের হাত কাটলে তো গোট দেশটাই একটা হাত কাটা দেশে পরিণত হবে। আমরা বলি, প্রথমে তাদের সতর্ক করা হবে, তাদের সম্মান-মর্যাদার ব্যবস্থা করা হবে। তাদের বৈধ আয় রোজগারের ব্যবস্থা করে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করা হবে। তারপরও যদি চুরি-ডাকাতি করে, তখন তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। পেটের দায়ে যারা চুরি করবে তাদের হাত কাটা হবে না। ইসলাম তাদের আয়ের ব্যবস্থা করে দিবে। যারা বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক-বীমা করার জন্য চুরি করবে তাদের প্রকাশ্যে হাত কাটার ব্যবস্থা করা হবে; যাতে গোটা দেশ এটা থেকে শিক্ষা নেয়। এরকম দুয়েকটি উদাহরণ নিশ্চিত করতে পারলে আশা করি চুরি বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে যিনার ব্যাপারেও উদাহরণ তৈরি করতে পারলে যৌন হয়রানিও বহুলাংশে বন্ধ হয়ে যাবে। মা বোনেরা নিরাপত্তা পাবেন। আল্লাহর বিধান কায়েম হলে দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীরা নির্মূল হবে। যারা সৎ ও পরিচ্ছন্নভাবে জীবন নির্বাহ করবে তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে। তারা নিরাপত্তা পাবেন, মুক্ত পরিবেশ পাবেন। তাদের থাকবে না কোনো ভয়-ভীতি।
তিনি বলেন, মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হলে সমাজকে চাঁদাবাজ মুক্ত হতে হবে, দখলদার ও সন্ত্রাস মুক্ত হতে হবে। আল্লাহকে ভয় করে চলে এমন একদল লোক তৈরি করতে হবে; যারা মিথ্যা কথা বলবে না, যারা মানুষকে ধোঁকা দিবে না। প্রতারণা করবে না, কারো ইজ্জতে হাত দিবে না। ঘুষ-দুর্নীতি করবে না এমন মানুষ ঘরে ঘরে তৈরি করতে হবে। তবেই মানবিক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
তিনি অন্তর্বর্তী সরকার ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রসঙ্গে বলেন, আমরা এই সরকারের প্রতি আধা-আধি সন্তুষ্ট। এটা কোনো দলীয় সরকার নয়। তারা একমতের মানুষ নন। তাদের সকল কর্মকান্ড- একমুখী হয় না। ফলে দেশবাসীকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। কিছু দিন আগে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সরকারের নিকট সুপারিশমালা জমা দিয়েছে। তাদের সুপারিশমালায় কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী বেশকিছু বিষয় রয়েছে। তারা সমাজকে যে জায়গায় নিয়ে যেতে চান, তা জাতির জন্য লজ্জাকর। তারা দেশকে এক সর্বনাশা পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে চায়, আমরা তা হতে দিবনা ইনশাআল্লাহ। আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের একটি নির্দিষ্ট কৃষ্টি-কালচার, তাহজিব-তামাদ্দুন এবং আচার-প্রথা রয়েছে, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তার ব্যত্যয় ঘটতে দেওয়া হবে না। তাদের সমাজবিধ্বংসী সুপারিশমালা আমরা মানব না। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বলতে চাই, আপনি দেশে ফিরে প্রথমেই কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী এবং বিতর্কিত সুপারিশমালা বাতিল করুন। এই জাতীয় কমিশনে ঈদানদার মহিলাদের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে, যারা কুরআন-হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন।
দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশবাসী পবিত্র রমজান মাসটি সুন্দরভাবে কাটাতে পেরেছেন। কিন্তু আবার মনে হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল হতে যাচ্ছে। সরকারের উচিত সে দিকে নজর দেওয়া। সমাজের শৃঙ্খলা বিনষ্টকারীদের পাকড়াও করুন। দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট ভেঙে দিন।
গণহত্যা প্রসঙ্গে আমীরে জামায়াত বলেন, যারা গণহত্যা সংঘটিত করেছে তাদেরকে আইনের বাইরে রাখবেন না। তাদের বিচার নিশ্চিত করুন। তাদের বিচার দৃশ্যমান করুন। বিগত সাড়ে ১৫ বছরের জঞ্জাল দূর করতে পর্যাপ্ত সংস্কার করুন। কালো টাকা ও পেশিশক্তি থেকে বের হয়ে এসে সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য সমানুপাতিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। শুনতে পাচ্ছি আগামীর সংসদ উচ্চ ও নিম্ন দুই কক্ষ বিশিষ্ট করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। মূল কর্তৃত্ব থাকবে নিম্ন কক্ষের হাতে; যেটা গঠিত হবে বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে। আর উচ্চ কক্ষের নির্বাচন হবে পিআর পদ্ধতিতে। দেশবাসীর প্রশ্ন উচ্চ কক্ষ যদি পিআর সিস্টেমে হয় তবে নিম্ন কক্ষ নয় কেন? আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হল আগামীর নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা জাতিকে উদাহরণ সৃষ্টিকারী নির্বাচন উপহার দেওয়ার কথা বলছেন। আমার তাদের এসিড টেস্ট দেখতে চাই। আমরা তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, স্থানীয় সরকার না থাকার কারণে জাতি নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিন। স্থানীয় নির্বাচনের এসিড টেস্ট এর মাধ্যমে আপনাদের সক্ষমতা এবং সদিচ্ছা দেখতে চাই। আপনাদের কাজে সন্তুষ্ট হলে জনগণ আপনাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে যাবে। আর যদি তার ব্যত্যয় ঘটে তবে জনগণ আপনাদের লাল কার্ড দেখাবে। কোনো দল বা গোষ্ঠীকে বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়া হলে তা আমরা কিছুতেই মানব না। আমরা ১৮ কোটি মানুষকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে।
তিনি জাতির উদ্দেশে বলেন, নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাখুন। ন্যায় ও সত্যের পথে সংগঠিত থাকুন। হয়তো অপরাধীদের দমন করার জন্য সরকারকে সহযোগিতা করতে আমাদেরও রাস্তায় নামতে হতে পারে। তার জন্য আপনারা তৈরি হোন এবং সতর্ক থাকুন। অতীতে যা চলেছে এখনো যদি তাই চলে তবে এত রক্ত এত জীবন গেল কেন? এত শহীদ এত আহত এত পঙ্গু তাদের কাছে আমরা কী জবাব দিব? জাতির কাছে কীভাবে মুখ দেখাব! তাই শহীদ ও আহতদের প্রতি সম্মান রেখে বাংলাদেশকে জঞ্জাল মুক্ত, কলুষ মুক্ত, ঘুষ-দুর্নীতি মুক্ত, দুঃশাসন মুক্ত করার জন্য আমরা আবারও জীবন দিতে প্রস্তুত আছি। অতীতের দুরাচার, স্বৈরাচার, দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের থেকে শিক্ষা নিন। তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, দেশের ২৮ লক্ষ কোটি টাকা কারা চুরি করেছে? ফ্যাসিবাদ পালিয়ে গেছে। এখন আর কোনো ভয় নেই। তাই নির্ভয়ে বলুন এই টাকা আওয়মী লীগ ও তাদের দোসররা চুরি করেছে। তারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে। আমরা সরকারকে বলছি পাচারকৃত সকল টাকা ফেরত আনা হোক। দুর্বৃত্তরা টাকা পয়সা চুরি করে বিদেশে পালিয়ে গেছে। তাই আমি ইউরোপ সফরে গিয়ে তাদেররকে বলেছি আমাদের টাকা ফেরত পেতে সহযোগিতা করুন এবং দুর্বৃত্তদের আমাদের হাতে তুলে দিন।
তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, তোমাদের কাছে আমাদের বিনয়ী অনুরোধ, বিশ্বের সকল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তরুণদের বাহুর উপর ভর করে। এমনকি জুলাই আন্দোলনও হয়েছে তাদের নেতৃত্বেই। তোমরা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করেছে, সে লড়াই থেকে তোমরা বিশ্রাম নিও না, যতক্ষণ না তোমাদের দাবি পূরণ হয়। তোমরা কুরআনের বিধানকে বুকে ধারণ কর। আল্লাহর শক্তিতে বলিয়ান হয়ে অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। তোমরা হবে আগামীর নেতা আর আমরা হব তোমাদের সহকর্মী। জাতির খেদমত করার জন্য তোমাদের সুযোগ করে দিতে চাই। এগিয়ে আস সত্য ও ন্যায়ের দিকে। ইনসাফের দিকে। এগিয়ে আস দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন, আমীন।
বিশেষ অতিথি এড. মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আজকে পবিত্র জুমার দিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদেরকে সামনে রেখে জাতির উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখবেন আমীরে জামায়াত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমীরে জামায়াতের বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ৫৫-তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এই ৫৫ বছরে বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হতে পারে নাই। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে সম্মান এবং মর্যাদার সাথে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বরং বিগত ৫৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিশেষ করে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট আমলের ২৮ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। মানুষের সবচাইতে বড় আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগকে ধ্বংস করা হয়েছে। এখান থেকে সাজানো রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে হত্যা করে বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার, কাজের অধিকার, ফান্ডামেন্টাল রাইটস, বেসিক রাইটসহ সবকিছুকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। সাড়ে ১৫ বছর পর আজকে একটি মুক্ত বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি। সেজন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া, আলহামদুলিল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ একটি পরিবর্তন চায়। এ পরিবর্তনের জন্য কমপক্ষে পাঁচটি উপাদান দরকার। তার মধ্যে একটি হচ্ছে নেতৃত্ব। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে মানুষ স্বপ্ন দেখে সংগঠিত হয়ে পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনেক শুকরিয়া যে আজকে ৫৫ বছর পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এমন একজন নেতা পেয়েছে যে নেতার নেতৃত্বে শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, সারা বাংলাদেশের মানুষ একটি ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছে। এই নেতৃত্বের মাধ্যমে আমরা আগামী দিনে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছি এবং জামায়াতে ইসলামী সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে ইনশাআল্লাহ।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে পরিবর্তনের জন্য একটি মজবুত সংগঠনের দরকার। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এ দেশের সর্ববৃহৎ একটি রাজনৈতিক শক্তি। জামায়াত আগামী দিনে একটি পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিবে এটাই স্বাভাবিক।
তৃতীয়টি হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে নেতাদের ত্যাগ এবং কুরবানীর মাধ্যমে। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশের মাটিতে সবচাইতে বেশী রক্ত, সবচাইতে বেশী কুরবানী দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে ইসলামীর তদানীন্তন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। উপমহাদেশের বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর গোলাম আযমকে কারাগারে আটক রেখে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্বনন্দিত মুফাসসীরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এত বড় ত্যাগ, এত বড় কুরবানী বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল অতীতে কোন দিন দেয়নি। সুতরাং জামায়াতের এই ত্যাগ এবং কুরবানীর কারণেই বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনতা আজকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে আগামী দিনে জামায়াতকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নেয়ার লক্ষ্যে।
তিনি বলেন, এরপর আরেকটি জিনিস দরকার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ‘কন্ট্রিবিউশন টু দ্যা ন্যাশন’ একটি রাজনৈতিক দলের অবদান। জাতির প্রতি তার অবদান। জামায়াতে ইসলামীর এককভাবে জাতির প্রতি অবদান সবচাইতে বেশী। ১৯৮০ সালের ৭ ডিসেম্বর তদানীন্তন আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষ থেকে আব্বাস আলী খান সাহেব কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী এমন একটি পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলো যে পদ্ধতি ছাড়া দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় সমস্ত রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত একমত হয়েছিল কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সুতরাং জাতির প্রতি জামায়াতের এই অবদান। এই অবদানের কারণে আগামী দিনের জনগণ জামায়াতকেই তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল হিসেবে গ্রহণ করে নিবে ইনশাআল্লাহ।
এবার জামায়াত আরেকটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। আপনারা জানেন, আমীরে জামায়াত ৯ অক্টোবর জাতির সামনে এই প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাব হচ্ছে, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের একশত ভাগ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। আমরা বিশ্বাস করি, একদিন বাংলাদেশের জনগণ এই পদ্ধতিও গ্রহণ করে নিবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী যে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমীরে জামায়াত দীর্ঘ কারাবরণ করার পর মুক্ত পরিবেশে ফিরে এসে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলেই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য যে ডাক দিয়েছিলেন আজকে বাংলাদেশ মুক্ত পরিবেশে আসার পর তিনি তার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছেন। আপনারা লক্ষ্য করছেন, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া বাংলাদেশের এমন কোন জনপদ নেই যেই জনপদে আমীরে জামায়াতের পদধূলি পরে নাই। আমরা ময়মনসিংহ বিভাগের জনশক্তিগণ উনাকে আরও আগেই আনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ আজকে অনেক শহীদের রক্তে রঞ্জিত শহীদ মঞ্জুরুল কবির, শহীদ কামরুল আহসান, শহীদ শওকত হোসেন তালুকদার, শহীদ আলাউদ্দিন, শহীদ কামারুজ্জামানের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশে আমীরে জামায়াত আজকে আগমন করেছেন। উনার এই জনসভায় এই কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে আগামী দিনে আমরা দ্রুত এগিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশের এই অংশের ময়মনসিংহের পাঁচটি জেলায় আমরা আমাদের দাওয়াতী তৎপরতা ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে আগামী দিনের পরিবর্তনের নেতৃত্বের অংশীদার হতে চাই। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের সকল প্রচেষ্টা কবুল করুন। সবাইকে ধন্যবাদ।
আরও বক্তব্য রাখেন মহানগর নায়েবে আমীর আসাদুজ্জামান সোহেল, জেলা নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ কামরুল হাসান মিলন, কিশোরগঞ্জ জেলা আমীর অধ্যাপক রমজান আলী, নেত্রকোনা জেলা আমীর অধ্যাপক সাদেক আহমাদ হারিছ, জামালপুর জেলা আমীর এড. আবদুল আওয়াল, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হাফেজ রাশেদুল ইসলাম, মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক আল হেলাল তালুকদার, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা বদরুল আলম, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নেতা উত্তম ভট্টাচার্য, মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি এমদাদুল ইসলাম, জুলাই আন্দোলনের শহীদ সাগরের পিতা জনাব আসাদুজ্জামান আসাদ, মাহিনের পিতা জনাব জামিল হোসেন সোহেলসহ স্থানীয় জামায়াত ও শিবিরের নেতৃবৃন্দ।
এমএম