tnbd-logo tnbd-logo
tnbd-logo tnbd-logo-light
মতামত প্রকাশনার সময়: ০৭ জুলাই ২০২২, ২০:৩৫ পিএম

কোরবানির পশুর হাট ও ঈদুল আজহার অর্থনীতি


Cattle-2022

ড. মো. জামাল উদ্দিন : পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পশুর দাম বাড়তে পারে বলে ধারণা অনেকের পদ্মা সেতুর বদৌলতে দক্ষিণাঞ্চল থেকে খুব দ্রুত পশুবাহি গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করছে। স্বপ্নের এই সেতুর কারণে এবারের ঈদে খামারিরা লাভবান হবেন এবং অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা যায়। বিদেশ থেকেও অনলাইনে ক্রেতারা কোরবানির পশুর বুকিং দিতে শুরু করেছেন।


ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সারা দেশে এখন জমে উঠছে কোরবানির পশুর হাট। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য পশু কোরবানি দেওয়া এই উৎসবের প্রধান উপলক্ষ্য। এই ঈদকে কেন্দ্র করে গবাদি পশু কেনাবেচায় অর্থপ্রবাহ বেড়ে যায় বহুগুণ। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব চলে আসে। সামর্থ্য অনুযায়ী ধনী-গরিব সবাই পশু কোরবানি করেন। ফলে কোরবানি হওয়া পশুর সংখ্যা বেড়ে যায় প্রতি বছর।

বহু হতদরিদ্র পরিবার তাদের আয় বৃদ্ধি ও পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য কোরবানি সামনে রেখে বহু যত্ন-আত্তিতে পশুপালন করে থাকেন। এ ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয় সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে ঈদের আগে পশু কেনাবেচা বেড়ে যায়। গত দুই বছর করোনার কারণে এই অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়েছিল। চলতি মৌসুমে করোনার প্রাদুর্ভাব থাকলেও বাজারে চাঙ্গাভাব লক্ষণীয়। তবে স্বাস্হ্যবিধি মেনে বাজারে পশু কেনাবেচা করা সবারই জন্য উত্তম।

অন্যদিকে বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোতে গবাদি পশু নিয়ে অনেকটা বিপদে পড়েছেন খামারিরা। পশুখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পশুর দাম বাড়তে পারে বলে ধারণা অনেকের। বন্যার্ত এলাকায় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পশু আনা-নেওয়ার কাজও চলছে। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য প্রণোদনা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানা যায়। পদ্মা সেতুর বদৌলতে দক্ষিণাঞ্চল থেকে খুব দ্রুত পশুবাহি গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করছে। স্বপ্নের এই সেতুর কারণে এবারের ঈদে খামারিরা লাভবান হবেন এবং অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা যায়।

চাহিদার আলোকে পশু সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তত্পরতা চালানো হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যসূত্র উল্লেখপূর্বক জাতীয় দৈনিক পত্রিকার বরাতে জানা যায়, ২০১৬ সালে ৯৮ লাখ ১৩ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০১৭ সালে ১ কোটি ৪ লাখ এবং ২০১৮ সালে ১ কোটি ৬ লাখ। এভাবে ক্রমাগত পশু কোরবানির সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার পশু কোরবানি হয়।

২০২০ সালের মার্চ থেকে কোভিড ১৯ সংক্রমণ মানুষের জীবনযাপনে বিরূপ প্রভাব ফেলায় পশু কোরবানির সংখ্যা কমে হয় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩টি। উক্ত সূত্রমতে, ২০২১ সালে পশু কোরবানির সংখ্যা আরো হ্রাস পেয়ে হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি। কোরবানিযোগ্য অবিক্রীত পশুর সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৫২৩। ফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছিলেন খামারি-ব্যাপারীরা। গোখাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি ২০০-৪০০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় গরুর দাম বাড়তি হবে বলে সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে।

উক্ত সূত্রমতে, এবার ঈদুল আজহায় ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি পশু কোরবানি দেওয়া হবে। এর মধ্যে গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানির জন্য ইতিমধ্যে ৪২ লাখ ৪০ হাজার গরু-মহিষ ও ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ছাগল-ভেড়া মোটাতাজাকরণ করা হয়েছে। গত দুই বছরের তুলনায় এখন অর্থনীতি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়। গতবারের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন খামারিরা, এটিও আশা করা যায়।

ঈদ উপলক্ষ্যে দেশের খামারিরা লাখ লাখ গরু-ছাগল বিক্রির জন্য হাট-বাজারে নিচ্ছেন। করোনা বাড়তির দিকে থাকায় অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। ডিজিটাল পশুর হাট, ই-কমার্স প্ল্যাটফরম (মার্কেট প্লেস), ই-কমার্স সাইট, ওয়েবসাইট, ফেসবুকভিত্তিক সাইটগুলোতেও ইতিমধ্যে কোরবানির পশুর বুকিং ও বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। এ সবই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল। বিদেশ থেকেও অনলাইনে ক্রেতারা কোরবানির পশুর বুকিং দিতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।

গত কয়েক দিনে অনলাইনে প্রায় ২০৬ কোটি টাকায় ২৬ হাজার ৩০৮টি গবাদি পশু বিক্রি হয়েছে, যা ৭৪১টি অনলাইন বাজারের তথ্যের ভিত্তিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এ তথ্য জানায়। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক। প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের এক বা দুই দিন আগে ক্রেতাদের বাসায় বাসায় গিয়ে কোরবানির পশু পৌঁছে দেবে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার রয়েছে। শুধু কোরবানির পশু বিক্রিই নয়, বুকিং করে দিলে জবাই দিয়ে বাসায় মাংস পৌঁছে দেওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

সূত্রমতে, এই কার্যক্রমের আওতায় মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর মধ্যে এখন পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ১৯ হাজার গবাদি পশু অনলাইনে বিক্রির কথা রয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর অনলাইনে পশু বিক্রির সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর সারা দেশে অনলাইন-অফলাইনে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার গবাদি পশু কোরবানি উপলক্ষ্যে বিক্রি হয়। অনলাইনে কেনা কোরবানির পশুতে কোনো ত্রুটি পেলে ফোনে বা ই-মেইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ই-ক্যাব) কাছে অভিযোগ করা যাবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির জন্য খামারিদের সংশ্লিষ্ট অনলাইন প্ল্যাটফরমের সঙ্গে সংযোগের সহযোগিতা প্রদান করবে এবং আপলোডকৃত গবাদি পশুর ক্ষেত্রে মালিকের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, গবাদিপশুর বয়স, ওজন, মূল্য ও গবাদি পশুর ছবি প্রদান করতে হবে।

প্রতি বছরের মতো সরকার এবারও ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা সঠিকভাবে প্রতিপালিত হলে কোরবানিকেন্দ্রিক চামড়া বিক্রির সংকট দূরীভূত হবে। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়, তার অধিকাংশই হয় কোরবানির সময়। কোরবানির চামড়ার দাম দেশে কম হলেও দেশে-বিদেশে চামড়াজাত পণ্যের দাম বেশ চড়া। কাঁচা চামড়া পরিবহনে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ থাকলে সুফল মিলবে।

দেশের চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে গবাদি পশু পালন করা গেলে কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজা করার প্রয়োজন পড়ে না। এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিমের মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা গরু চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এদিকে ঈদের অন্যান্য বাজারেও (যেমন- শপিংমল, কামারের দোকান প্রভৃতি) প্রাণচঞ্চলতা দেখা দিয়েছে। আশা করা যায়, ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে সরকারের মহতি উদ্যোগগুলো দেশের অগণিত খামারির জীবনের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। সেই সঙ্গে ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত কোরবানির আদর্শ সফলকাম হবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ; সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, এফএও, জাতিসংঘ

এইচএন