এটা এমন এক বিস্ময়কর ঘটনা,যার সামনে বিশ্বের মহান চিন্তাবিদরা থমকে দাড়াতে বাধ্য হয়েছেন,পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে স্তুতি-বন্দনায় মুখিরত হয়েছেন এই নজিরবিহীন আত্মত্যাগের। কারণ,কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের মহানায়করা ‘‘অপমান আমাদের সয়না”-এই স্লোগান ধ্বনিত করে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংখ্যায় হাতে গোনা জনাকয়েকটি হওয়া সত্ত্বেও খোদায়ী প্রেম ও শৌর্য়ে পূর্ণ টগবেগ অন্তর নিয়ে জিহাদ ও শাহাদাতের ময়দানে আবির্ভূত হন এবং প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার অধঃজগতেক পেছনে ফেলে উর্দ্ধজগতে মহান আল্লাহর সনে পাড়ি জমান। তারা স্বীয় কথা ও কাজের দ্বারা জগতবাসীকে জানিয়ে দিয়ে যান যে,‘‘যে মৃত্যু সত্যের পথে হয়,তা মধূর চেয়েও সুধাময়।’’

বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমানের জীবনপটে যেমন,তেমনি তাদের পবিত্র বিশ্বাসের পাদমূলে আশুরার সঞ্জীবনী ধারা বাহমান। কারবালার আন্দোলন সুদীর্ঘ চৌদ্দশ’ বছর ধরে-সুগভীর বারিধারা দ্বারা তৃষ্ণা নিবারণ করে এসেছে প্রাণসমূহের। আজও অবধি মূল্যবোধ,আবেগ,অনুভূতি,বিচক্ষণতা ও অভিপ্রায়ের অযুত-অজস্র সুক্ষ্ণ ও স্থুল বলয় বিদ্যমান যা এই আশুরার অক্ষকে ঘিরে আবর্তনশীল। প্রেমের বৃত্ত অঙ্কনের কাটা-কম্পাস স্বরূপ হলো এ আশুরা।

নিঃসন্দেহে এই কালজয়ী বিপ্লবের অন্তঃস্থ মর্মকথা এবং এর চেতনা,লক্ষ ও শিক্ষা একটি সমৃদ্ধশালী,নিখাদ ও প্রেরণাদায়ক সংস্কৃতি গঠন করে। প্রকৃত ইসলামের সুবিস্তৃত অঙ্গনে এবং আহলে বাইেতর সুহৃদ ভক্তকুল,ছোট-বড়,জ্ঞানী-মূর্খ নির্বিশেষে সর্বদা এই আশুরা সংস্কৃতির সাথেই জীবন যাপন করেছে,বিকিশত হয়েছে এবং এ জন্যে আত্মাহুতি দিয়েছে। এই সংস্কৃতির চর্চা তাদের জীবেন এত দূর প্রসারিত হয়েছে যে জন্মক্ষণে নবজাতেকর মুখে সাইয়্যেদুশ শুহাদার তুরবাত (কারাবালার মাটি ) ও ফোরাতের পানির আস্বাদ দেয় এবং দাফনের সময় কারবালার মাটি মৃতের সঙ্গে রাখে। আর জন্ম থেকে মৃত্যু অবিধও সারাজীবন হোসাইন ইবনে আলী (আ) এর প্রতি ভালবাসা ও ভক্তি পোষণ করে,ইমামের শাহাদাতের জন্য অশ্রুপাত করে। আর এই পবিত্র মমতা দুধের সাথেই প্রাণে প্রবেশ করে আর প্রাণের সাথেই নিঃসিরত হয়ে যায়।

কীভাবে নবীর (সাঃ) উম্মতই নবীর (সাঃ) সন্তানকে হত্যা করলো (!) -এ জিজ্ঞাসা সবযুগের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। আর এ ধরনের প্রশ্ন জাগাটাও খুব স্বাভাবিক। কেননা,ইমাম হোসাইনের (আঃ) মর্মান্তিক শাহাদাত এক বিষাদময় ঘটনা কিংবা আল্লাহর পথে চরম আত্মত্যাগের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্তই শুধু নয়,এ ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে বড়ই অদ্ভুত মনে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর তিরোধানের মাত্র ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ হত্যাকা- চালানো হয়। আর এ হত্যাকা-ের নায়ক ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সাঃ) উম্মত যারা রাসূল এবং তার বংশকে ভালবাসে বলে ইতোমধ্যেই খ্যাতিলাভ করেছিল। তাও আবার রাসূলের (সাঃ) সেইসব শত্রুদের পতাকাতলে দাড়িয়ে মুসলমানরা রাসূলের (সাঃ) সন্তানের উপর এ হত্যাকা- চালায় যাদের সাথে কি-না রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র তিন-চার বছর আগ পর্যন্ত ও অব্যাহতভাবে যুদ্ধ করে গেছেন!

মক্কা বিজয়ের পর যখন চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার তখন ইসলামের ঐ চির শত্রুরাও বাধ্য হয়েই নিজেদের গায়ে ইসলামের একটা লেবেল লাগিয়ে নেয়। তাই বলে ইসলামের সাথে তাদের শত্রুতার কোনো কমিত ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের উক্তিটি সুপ্রযোজ্য । তিনি বলেছিলেন-

“তারা মুসলমান হয়নি,ইসলাম গ্রহনের ভান করেছিল মাত্র।” আবু সুফিয়ান প্রায় ২০ বছর যাবত রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে যুদ্ধ করে। শুধু তাই নয়,শেষের দিকে ৫/৬ বছর সে ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং ফেতনা সৃষ্টিতে সরদারের ভূমিকা পালন করে।মোয়াবিয়া তার পিতার কাধে কাধ মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতায় নামে। এভাবে আবু সুফিয়ানের দল অর্থাৎ উমাইয়ারা ইসলামের চরমতম শত্রুতে পরিণত হয়। অথচ আমরা অত্যন্ত আশ্চর্য়ের সাথে প্রত্যক্ষ করি যে,রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ওফাতের মাত্র দশবছর পরে সেই মোয়াবিয়া এসে ইসলামী শাসনযন্ত্রের শীর্ষে আরোহণ করে শাম বা সিরিয়ার গভর্ণর হয়ে বসে। আরও বিশবছর পরে ইসলামের এই শত্রু হয়ে বসলো স্বয়ং মুসলমানদের খলীফা! এখানেই শেষ নয়,রাসূলের (সাঃ) মৃত্যুর পর পঞ্চাশ বছর পর এবার মুসলমানদের খলীফা হল মোয়াবিয়া-পুত্র ইয়াযিদ। আর এই ইয়াযিদ নামায,রোযা,হজ্ব যাকাত তথা ইসলামের বিধি-বিধান পালনকারী মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে অর্ধশতাব্দী গড়াতে না গড়াতেই রাসূলের (সাঃ) সন্তানকে হত্যা করলো। এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মাথা বিগড়ে গেলেও ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। ঐ সব মুসলমানরা যে ইসলামকে পরিত্যাগ করেছিল তা নয়,বরং ইমাম হোসাইনের (আঃ) প্রতি তাদের ভক্তির অভাব ছিল তারও কোনো প্রমাণ মেলে না। কারণ,ইমাম হোসাইনের (আঃ) প্রতি বীতশ্রদ্ধ হলে তারা হয়তো বলতে পারতো যে,(নাউযুবিল্লাহ) ইমাম হোসাইন (আঃ) ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছেন। সুতরাং তাকে হত্যা করতে কোনো বাধা নেই। বরং তারা নিশ্চিতভাবে ইয়াযিদের ওপর ইমাম হোসাইনের (আঃ) সহস্র গুণে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় বিশ্বাস করতো। তাহলে এখন প্রশ্ন হল যে,প্রপ্রথমতঃ কিভাবে মুসলিম শাসন ক্ষমতা ইসলামের ঘোরশত্রু আবু সুফিয়ানের দলের হাতে পড়েলা? দ্বিতীয়তঃ যে মুসলমানরা ইমাম হোসাইনের (আঃ) রক্তের মূল্য যথার্থভাবে অবগত ছিল তারা কিভাবে ইমাম হোসাইনকে (আঃ) হত্যা করলো?

প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে,উমাইয়াদের মধ্যে প্রথমভাগে মুসলমান হবার গৌরব অর্জন করেছিল এবং ইসলামের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করতো না,বরং ইসলামের জন্যে অনেক অবদানই রেখেছিল এমন ব্যক্তির (অর্থাৎ ওসমানের) খলীফা পদ লাভই ছিল এর মূল কারণ। এর ফলেই উমাইয়ারা সর্ব প্রথম মুসলিম খেলাফত লাভ করার সুযোগ পায়। আর,এ সুযোগকে ব্যাবহারকরে তারা ইসলামী শাসন ব্যাবস্থাকে নিজেদের মুলুকে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বয়ং মারওয়ানই এর জলন্ত উদাহরণ। অবশ্য হযরত ওমরের শাসনামলেই মোয়াবিয়াকে শাম বা সিরিয়ার গভর্ণর হিসেবে নিযুক্তির মাধ্যমেইসলামী শাসনযন্ত্রে উমাইয়াদের উত্থান ঘটে। পরবর্তিতে অন্য সব গভর্ণরের পদে রদবদল করা হলেও মোয়াবিয়াকে তার পদে বহাল রাখা হয়। এটাই ছিল মুসলিম শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে উমাইয়াদের হীনতুবাসনা চরিতার্থ করণের পথে প্রথম অনুকূল ইঙ্গিত।

উমাইয়ারা হযরত ওসমানের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়ায় ও গোলযোগ সৃষ্টি করে। এতে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শেষ পর্যন্ত মোয়াবিয়া তার সে লালসা পুরণের জন্য মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল। সে নিজন্যের পক্ষ থেকে ওসমানকে ‘মজলুম খলীফা’,‘শহীদ খলীফা’ প্রভৃতি সুবিধামত স্লোগান দিয়ে প্রচারকার্য শুরু করলো এবং স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে আদাজল খেয়ে লেগে গেল। সন্দেহযরত ওসমানের রক্তভেজা জামা সবার সামনে মেলে ধরে তার মজলুমস্তকে গতিশীল রূপ দেয় এবং বলে বেড়ায়,‘যেহেতু ওসমানের হত্যার পর আলী (আঃ) খলীফা হয়েছেন,তাছাড়া ওসমানের হত্যাকারীদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন- সুতরাং ওসমান হত্যার জন্য মূলতঃ আলীই (আঃ) দায়ী।’ এই বলে সে ভেউ ভেউ করে কাদতে থাকে যাতে মানুষের অনুভূতিকে আকৃষ্ট করতে পারে। তার এ প্রচেষ্টা সফলও হয়। কারণ,তার কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে অনেকেই চোখের পানি ঝরায় ও শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে মজলুম খলীফার রক্তের প্রতিশোধ নিতে যেই কথা-সেই কাজ-এই রুপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তারা মোয়াবিয়াকে আশ্বাস দেয়ঃ আমরা প্রস্তুত আছি,তুমি যা বলবে তাই আমরা পালন করতে রাজী আছি। এভাবে পদলোভী স্বার্থপর মোয়াবিয়া স্বয়ং মুসলমানদেরকে নিয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলে।

ইসলামের ঊষালগ্নের প্রহেলিকাময় ঘটনাবলী এবং নবীর (সাঃ) উম্মতের হাতে নবীর (সাঃ) সন্তানের হত্যার কারণ

ইতিহাসে বেশকিছু বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন ঘটনা রয়েছে যেগুলোর কারণ এবং সূত্র খুজতে গিয়ে অনেকেই হয়তো বিপাকে পড়েত পারেন। এগুলোর মধ্যে একটি হল ইসলামের উষালগ্নেই সমসাময়িক অন্যান্য মতামত এবং আকীদা-বিশ্বাসকে দাবিয়ে এর বেপরোয়া প্রসার।

আরকটি ঘটনা হল ইমাম হোসাইনের (আঃ) আন্দোলন এবং বিদ্রোহ। আত্মীয়-অনাত্মীয়,চেনা-অচেনা নির্বিশেষে সবাই কুকুফার লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার ইস্যু টেনে ইমাম হোসাইন (আঃ) কে বিরত রাখতে চেষ্টা করছিল। তারা যে ইমাম হোসাইনের (আঃ) জীবনের নিরাপত্তারক্ষকথা ভেবেই এ চেষ্টা চালিয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রহস্যের বিষয় হল যে,ইমাম হোসাইনও (আঃ) তাদের চিন্তাধারাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেননি। অথচ মক্কা,কারবালা এবং কুকুফার পথে তার বিভিন্ন ভাষ্য থেকে প্রপ্রতীয়মান হয় যে,ইমাম হোসাইনের (আঃ)ও একটা স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ছিল যা অনেক ব্যাপক ও দূরদর্শী। তার হিতাকাঙ্খীদের ভাবনা কেবল নিজন্যের এবং পরিবার-পরিজনদের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। অথচ,ইমাম হোসাইনের (সাঃ) চিন্তা দীন,ঈমান ও আকীদার নিরাপত্তাকে নিয়ে। তাই,মারওয়ানের এক নসীহতের জবাবে ইমাম হোসাইন (সাঃ) বলেনঃ

‘‘ইয়াযিদদের মতো কেউ যদি উম্মতের শাসক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের ক্ষান্তি ।’’

মোয়াবিয়া ও ইয়াযিদের ইসলামী শাসন ক্ষমতা লাভ এবং ইসলামে অবিচল মুসলমানদের নিয়ে যথাক্রমে হযরত আলী (আঃ) এবং ইমাম হোসাইনের (আঃ) বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন ছিল ইসলামের উষালগ্নের প্রহেলিকাময় ঘটনাবলীর অন্যতম। এখানে দুটি বিষয়কে খতিয়ে দেখা দরকার। তাহলেই ইমাম হোসাইনের (আঃ) বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা,এর কারণ,লক্ষ ও উদ্দেশ্য উদঘাটন করা আমাদের পক্ষে সহজতর হবে। প্রথমতঃ আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ইসলাম ও কুরআনের সাথে উমাইয়া বংশের তীব্র সংঘাত এবং দ্বিতীয়তঃ ইসলামী শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে তাদের সফলতা। ইসলামের সাথে উমাইয়াদের এহেন শত্রুতাসুলভ আচরণের কারণ হল যে,একাদিক্রমে তিন বংশ ধরে বিন হাশিম ও বনি উমাইয়ার মধ্যে গোষ্ঠীগত কোন্দল চলে আসছিল। অতঃপর যখন বিন হাশিম ইসলাম ও কুরআনের ধারক ও বাহক হবার গৌরব লাভ করে তখন বনি উমাইয়ারা ঈর্ষায় পুড়ে মরতে থাকে। ফলতঃ তারা বিন হাশিমকে সহ্র করতে পারলো না,সাথে সাথে ইসলাম ও কুকুরআনকেও না। দ্বিতীয় কারণ হলঃ তৎকালীন কোরাইশ গোত্রের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে উমাইয়াদের পার্থিব জীবনধারার সাথে ইসলামী বিধানের অসামঞ্জস্য ও বৈপরিত । এতে তাদের প্রভূত্বমূলকলক প্রভাব ক্ষুণ্ন হয়। তাদের ভাব ও মন-মানস ছিল সুবিধাবাদী ও বস্তুবাদী। উমাইয়াদের যথেষ্ট বুদ্ধি থাকেলও তাদের ঐ বস্তবাদী মানসিকতার কারণে খোদায়ী বিধান থেকে তারা উপকৃত হতে পারেনি। কারণ ঐশী শিক্ষাকে সে-ই অবনত মস্তকে গ্রহণ করতে পারে যার মধ্যে মর্যাদাবোধ,উম্মত আত্মা এবং মহত্বের আনাগোনা রয়েছে এবং যার মধ্যে সচেতনতা ও সত্যান্বেষী মনোবৃত্তি নিহিত আছে। অথচ উমাইয়ারা অতিশয় দুনিয়া চর্চা করতে করতে এসব গুণগুলোর সব ক’টি হারিয়ে বসেছিল। অগত্যা তারা ইসলামের সাথে শত্রুতায় নেমে পড়ে। পবিত্র কুরআনেও এ দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সত্যকে মেনে নেবার সক্ষমতা যাদের আছে তাদেরকে ইশারা করে কুরআনে বলা হয়েছেঃ

‘যাতে তিনি (রাসূল) সচেতনদের সতর্ক করতে পারেন।’’ (ইয়াসীনঃ ৭০)

কেবল তাদেরকেই সতর্ক করো যারা উপদেশ মেনে চলে’। (ইয়াসীনঃ ১১)

‘আমরা কুরআন অবতীর্ণ করি,যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত। আর তা জালেমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।’ (বনী ইসরাঈলঃ ৮২)

‘এটি এজন্য যে,আল্লাহ কুজনদেরকে সুজন হতে পৃথক করবেন।’ (আনফাল : ৪৮)

মোদ্দকথা,আল্লাহর রহমত থেকে তারাই উপকৃত হতে পারবে যাদের প্রস্তুতি ও যোগ্যতা রয়েছে। এটি একটি খোদায়ী নীতি। আর উমাইয়াদের মধ্যে সে প্রস্তুতি না থাকায় তারা ইসলাম এবং কুরআনের অমিয় সুধা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।

রাসূলের (সাঃ) চাচা হযরত আব্বাস এবং আবু সুফিয়ানের মধ্যে এক সাক্ষাতে তাদের মধ্যকারক্ষকথোপকথন থেকে আবু সুফিয়ানের নিরেট ও অন্ধ আত্মার প্রকাশ ঘটে।

কিন্তু উমাইয়া দল কিভাবে চিরকাল শত্রুতা করেও হঠাৎ করে একটা তৎপর ইসলামী দল হিসাবে আত্ম প্রকাশ করলো- উপরন্তু তারা ইসলামের শাসন ক্ষমতাকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে সক্ষম হলো? এ প্রশ্নের জবাবের শুরু তে একটা বিষয় উল্যেখ্য । তাহলো-নবনির্মিত ও নব প্রতিষ্ঠিত কোনো জাতি হঠাৎ করেই শক্তিশালী ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না,চাই সে ঐক্য যত শক্তিশালীই হোক না কেন।

একটু চিন্তা করলে আমাদের সামনে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হবে যে,আরবে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্টের ভিত মজবুত হতে না হতেই বিশেষ করে দ্বিতীয় খলীফার আমলে বেপরোয়াভাবে দেশজয় করে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটানো হয়। প্রকৃতপক্ষে তাড়াহুড়া করে নতুন নতুন দেশজয় করে ইসলাম প্রসারের চেয়ে বরং ধৈর্য ধরলে ইসলাম তার স্বাভাবিক গতিতে সীমান্ত অতিক্রমস্তকরে দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়তো-এটাই কি অধিকতর সমীচীন ছিল না? ঐ তাড়াহুড়ার পিরণাম হিসাবে আমরা পরবর্তিতে দেখতে পাই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিদ্যমান এসব -দ্বন্দ বিভেদ। প্রাথমিক যুগে ইসলাম প্রসারে ঐ বেপরোয়া নীতির ফলশ্রুতিতে প্রথমতঃ একটা অসমত্ব মুসলিম সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয় এবং দ্বিতীয়তঃ তা আরবের ইসলামী সংস্কৃতিতে অনারব ও অনৈসলামী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের পথ খুলে দেয়। ফলে অতি শীঘ্যই আরব তার স্বাতন্ত্র ও ইসলামী সাংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলে।

সেদিনকার নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর পতাকাতলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল বটে এবং জাতি-বর্ণের ব্যাব্যবধানকে দ্রুত মোযেজার ন্যায় মুছে ফলেতে সক্ষম হয়েছিল বটে কিন্তু বিভিন্ন গোত্র,ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ,রীতি-নীতি,আদব-কায়দা এবং ভিন্ন আকীদা-বিশ্বাসে গড়ে ওঠা মানুষগুলোর দীন ও দীনের আইন-কানুন মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সমান যোগ্যতা ও প্রস্তুতি ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে একজন গাঢ় ঈমানদার হলে আরেকজন যে দুর্বল ঈমানের অধিকারী ছিল একথা অস্বীকার করার জো নেই। আরেকজন হয়তো সন্দেহ ও বিভ্রান্তিতে নিপিতত ছিল এবং কেউ কেউ অন্তরে কুফরী মনোভাবও হয়তো পোষণ করতো। এ ধরনের একটা জনসমষ্টিকে বছরের পর বছর তথা শতাব্দীর পর শতাব্দী অবিধ একটা নির্দিষ্ট সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ধরে রাখা সহজ কথা নয়।

পবিত্রকুরআন একাধিকবার মোনাফিকদেরক্ষকথা উল্লেখ করেছে। মোনাফিকদের ব্যাপারে সতর্ক করার ধরন দেখে বোঝা যায় যে,এরা মারাত্মক। কুরআন মুসলমানদেরকে এই গুরুতর বিপদ থেকে রক্ষা করতে চায়। আব্দুল্লাহ ইবনে সালুল মদীনার মোনাফিকদের শীর্ষে ছিল। কুরআন ‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ এরক্ষকথা উল্লেখ করেছে যারা দায়ে পড়ে কিংবা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মুসলমানের তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়েছে। যাহোক,তারা যাতে আস্তে আস্তে খাটি মুসলমান হতে পারে সেদিকে তাদেরকে উৎসাহিত করা উচিত। বায়তুলমাল থেকে তাদেরকে সাহায্য করতে হবে যাতে অন্ততপক্ষে তাদের অনাগত বংশধররা খাটি মুসলমান হয়ে গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে গুরুত্ব কোনো পদে নিয়োগ করা মারাত্মক ভুল।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার দয়া ও সদাচরণ থেকে কাউেক বঞ্চিত করতেন না। এমন কি মোনাফিক এবং ‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ দেরকেও না। কিন্তু তাদের প্রতি সতর্কাবস্থা তিনি কখনই বর্জন করেননি। আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জীবদ্দশায় কোনো দুর্বল ঈমানদার,মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম কিংবা মোনাফিক উমাইয়াদের কেউই ইসলামী শাসনযন্ত্রের ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি। অথচ অত্যন্ত পিরতাপরে বিষয় হল,রাসূলের (সাঃ) মৃত্যুর পর থেকে বিশেষ করে হযরত ওসমানের আমলে তারাই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো কুক্ষিগত করে। রাসূলের (সাঃ) জীবদ্দশায় মারওয়ান ও তার বাবা হাকাম মক্কা ও মদীনা থেকে নির্বাসন প্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এ সময় তারা ফিরে আসার সুযোগ লাভ করলো। গত দুই খলীফার আমলেও তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা সংক্রান্ত হযরত ওসমানের অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ঐ মারওয়ানই ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি ও হযরত ওসমান হত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

হযরত ওসমানের সময় উমাইয়ারা বড় বড় পদে আসীন এবং বায়তুল মালে হস্তক্ষেপ করে। যেটুকু তাদের ঘাটতি ছিল তা হল ধার্মিকতা। কিন্তু হযরত ওসমানের হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে অদ্ভুত এক প্রতারণা ও ধোকাবাজির মাধ্যমে ‘ধার্মিক’ হবার গৌরবটাও তারা হাতে পায় এবং সেটাকেও তাদের লক্ষ্য চরিতার্থ করার কাজে নিয়োগ করে। আর এর বদৌলতেই মোয়াবিয়া দীন ও দীনের শক্তির নামে হযরত আলীর (আঃ) মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ও বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে মোয়াবিয়া আলেমদেরকে ভাড়া করে আরও একটা কৃতিত্ব বাড়ায়। অর্থাৎ এখন থেকে সে চারটি দিককে অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহারকরে মুসলমানদের শাসনমঞ্চে আবির্ভূত হয়। এগুলো ছিলঃ (১) বড় বড় রাজনৈতিক পদ (২) ধন-দৌলতের প্রাচুর্য (৩) অতিমাত্রায় ধার্মিকতা এবং (৪) দরবারী আলেম সমাজ।

হযরত ওসমানের যুগে উমাইয়াদের রাজনৈতিক উত্থান এবং বায়তুলমালের ছড়াছিড় দেখে দীনদার এবং দুদুনিয়াদার উভয়পক্ষই ক্ষেপে ওঠে। দুনিয়াদাররা তাদের চোখের সামনে উমাইয়াদের ভোগ-বিলাস সহ করতে পারেনি কারণ তারা তাদের নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে সচেতন ছিল। আর দীনদাররা দেখিছল যে,ইসলামী সমাজন্যের আশু ধ্বংস অনিবার্য। এ কারণেই দেখা যায় যে,আমর ইবনে আস যেমন এর বিরোধিতায় নামে তেমনি আবুজর বা আম্মারও এর বিরোধিতা করেন। আমর ইবনে আসম্ভবলেঃ ‘আমি এমন কোনো রাখালের পার্শ্ব অতিক্রমস্তকরিনি যাকে উসমানের হত্যার জন্যে উস্কানি দেই নি’। (চলবে)

লেখক-গবেষক, কলামিস্ট, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১।

এমএম