বছরের পুরনো দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলার এই ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে চলে এলেও সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে এই রীতি। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের তরুণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে এই ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ নেই বললেই চলে। অনেকে জানেই না হালকাতা কি জিনিস।
হালখাতা হলো বছরের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য ক্রেতাদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়; ‘শুভ হালখাতা কার্ড’-এর মাধ্যমে ওই বিশেষ দিনে দোকানে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করান। ক্রেতারাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করে দেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে ‘হালখাতা’র উদ্ভব। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট বড় মাঝারি যেকোনো দোকানেই এটি পালন করা হয়ে থাকে।
মূলত হালখাতার আচারটি বাঙালি মুসলমানদের দ্বারা শুরু হয়েছিল। বাঙালিরা হালখাতা শুরু করার আগে, হালখাতার প্রথম পাতায় ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ ও ‘এলাহি ভরসা’ লেখেন। ‘হাল’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি শব্দ ‘হাল’ এর অর্থ হচ্ছে ‘নতুন’। একসময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ একটি নতুন রীতি প্রচলন করেন, যেটি একসময় ‘পুণ্যাহ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় ‘পুণ্যাহ’ উৎসব হারিয়ে গেলেও হালখাতা এখনও স্বমহিমায় টিকে রয়েছে। হালখাতা খোলার আগে পুরান ঢাকার মুসলমানরা হালখাতার দাওয়াতের আয়োজন করে
এই হালখাতার দাওয়াতের পূর্বে শুভ হালখাতার দাওয়াতের পত্র বিতরণ করা হয় নিমন্ত্রণ জানাতে। এই দাওয়াতকে ঘিরে দোয়া মাহফিল ও মিলাদ মাহফিলের মতন বিভিন্ন বাঙালি ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। নতুন বছরের শুরুতে ব্যবসার মঙ্গল কামনা করেন। এইসব মাহফিল শেষে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়। অনেক ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখের আগের দিন ও পরের দিনের মাঝের যে কোনো একটি দিন বেছে নেয় হালখাতার দাওয়াত, দোয়া ও মিলাদ পরানোর জন্য। নববর্ষের দিন সকল ক্রেতা বা দর্শকদের মিষ্টি ও ঠান্ডা পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করে বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ীরা। হালখাতার মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি হয়। পরে হিন্দুরাও এই প্রথা গ্রহণ করে।
তবে এখন আর সেভাবে হালখাতা পালন করতে দেখা যায় না। যুগের পরিবর্তনে পাল্টে গেছে বেচাকেনা আর লেনদেনের মাধ্যম। ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করেন। হিসাব-নিকাশের জন্য বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটার ও বিশেষায়িত সফটওয়্যার। এখন আর কার্ড বা চিঠির মাধ্যমে বকেয়া হিসাব স্মরণ করিয়ে দিতে হয় না। তার স্থান নিয়েছে ই-মেইল ও মোবাইল। অনেকেই এখন কার্ডে কেনাকাটা করেন, বকেয়া পরিশোধ করেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ফলে কার্ড ছেপে দাওয়াত কিংবা টালি খাতা কিনে হিসাব-নিকাশ করার কোনো তোড়জোড়ও নেই।
ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য সামান্য কিছু আয়োজন হয়ে থাকে রাজধানীর পুরান ঢাকা এলাকায়। শ্যামবাজারের বিসমিল্লাহ আড়তের মালিক ইদ্রিস আলম বলেন, ‘এই রীতি বাবা-দাদাদের আমল থেকে চলে আসছে। এই বাজারে কৃষিপণ্য নিয়েই ব্যবসা চলে। তাই একেক ক্রেতার কাছে আমাদের পাওনা ২-৩ কোটি টাকার মতো হয়ে থাকে। যেহেতু আমাদের ব্যবসার পরিধি বড়, আমাদের হালখাতাও চলে কয়েক দিন ধরে। নতুন বছরে ব্যবসার সমৃদ্ধি কামনায় দোয়ার আয়োজনও করা হয়েছে।’
পুরান ঢাকার শাখাড়িবাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘পুরানো বাকী যা থাকে কাস্টমার আসে, তারা আমাদের পুরানো খাতার হিসাব শেষ করে দেখা যায় যে আবার নতুন করে বাকী শুরু করে। এবার যেহেতু ঈদ পরে গেছে তাই কম মানুষ আসার সম্ভাবনা আছে।’
পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় বাকীতে বিক্রিও কমে গেছে অনেক। আবার বেশিরভাগ ব্যবসায়ী এখন বাংলা মাসে হিসাব রাখেন না। এছাড়াও খাতার বদলে চালু হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যম। এসব কারণে হালখাতার আবেদন ও আয়োজনে ভাটা পড়েছে। তবে এখনো হালখাতার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন সোনা-রূপার ব্যবসায়ীরা।
তাঁতীবাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগে যতটা জাঁকজমকভাবে হতো এখন অতটা জাঁকজমক হয় না। আমি আরও ১৫–২০ বছর আগে দেখেছি অনেক বড় পরিসরে হালখাতা হতো তাঁতীবাজারে। হিন্দু মুসলিম আমরা পুরান ঢাকা বা তাঁতীবাজারে যারা আছি, সবাই মিলেমিশে একত্রেই আয়োজন করি। এটা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রধান অংশ। এখানে হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ নেই। প্রত্যেক বছরই আমরা হালখাতা করি।’
এমএম