এসব মামলার এজাহারনামীয় অনেক আসামিকে চেনেন না বাদীরা। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের যোগসাজশে মামলা বাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন অনেক সাধারণ মানুষ।
রংপুর রেঞ্জ পুলিশের ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার ঘটনায় রংপুর জেলায় ৫টি, গাইবান্ধায় ৫টি, কুড়িগ্রামে ১০টি, লালমনিরহাটে ২টি, নীলফামারীতে ৯টি, দিনাজপুরে ১৫টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১০টি, পঞ্চগড় জেলায় ৬টিসহ মোট ৬২ মামলায় ৪ হাজার ২৪২ জন এজাহারনামীয় আসামি ও ১৫ হাজার ৬৯৬ জন অজ্ঞাত আসামি। এর মধ্যে গত ৫ মাসে ১ হাজার ১৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রংপুর মেট্রোপলিটনে ১৬ মামলায় ৩ হাজার ৬৫৬ জন আসামির মধ্যে ৯০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
অভিযোগে জানা যায়, ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার মামলায় নিরীহ লোককে আসামি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হেডকোয়ার্টারের নির্দেশনা মেনে তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধেই শুধু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
রংপুর মেট্রোপলিটন ও রংপুর রেঞ্জে দায়েরকৃত একাধিক মামলা অনুসন্ধানে দেখা যায়, আসামিদের অধিকাংশকেই বাদীরা চেনেন না। বাদী মামলা দায়ের করলেও অপরাধীদের নাম তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই রংপুর সিটি বাজারের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সবজি বিক্রেতা সাজ্জাদ হোসেন। নিহতের ঘটনার এক মাস পর ২০ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাসহ ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন নিহত সাজ্জাদ হোসেনের স্ত্রী জিতু বেগম। এর কিছুদিন পরেই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিহত সাজ্জাদ হোসেনের মা ময়না বেগম বাদী হয়ে ৪৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। একই বিষয়ে দুটি মামলা হওয়ায় আদালত সিআর মামলা হিসেবে গ্রহণ করে আগের মামলাটি চলমান রাখার আদেশ দেন।
এই সিআর মামলার আসামি পীরগাছা উপজেলার মনুরছড়া গ্রামের শফিকুল ইসলামকে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে মামলার নথিতে উল্লেখ করা হলেও জীবনে কোনোদিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তিনি। আসামি শফিকুলকে সামনে দেখেও চিনতে পারেননি বাদী ময়না বেগম। এই মামলা থেকে নাম কাটাতে ও মামলার নথিপত্র তুলতে ইতোমধ্যে কয়েক হাজার টাকা খুইয়েছেন শফিকুল, হয়েছেন হয়রানির শিকারও। রংপুর জজকোর্টের অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন জানান, অনেক মামলা নিয়েই তো বাণিজ্য হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নিহত সাজ্জাদের পরিবার অনেক গরিব। আমার সিনিয়র আইনজীবী বলেছিলেন, সে জন্য আমি শুধু মামলার নথিতে স্বাক্ষর করেছিলাম। পরে আদালত এই মামলাটিকে সিআর হিসেবে গ্রহণ করে এই ঘটনায় পূর্বের মামলা চলমান রাখার আদেশ দেন। আমি পরবর্তী সময়ে বাদীকে বলেছি, এই মামলা নিয়ে আর আমার সঙ্গে দেখা করবেন না। আমি কোনো রাজনীতি করি না। আর কোনো নিরীহ লোক হয়রানির শিকার হোক এটা চাই না।
রংপুর মেট্রোপলিটনের তাজহাট থানায় গত ৭ জানুয়ারি মিঠাপুকুর উপজেলার রহমতপুরের পাপুল বাদী হয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত হওয়ার ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ রয়েছে, এই মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষকেও আসামি করা হয়েছে। পাপুলের মামলায় আসামি হয়েছেন মিঠাপুকুর উপজেলার জায়গীরহাট উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের ল্যাব সহকারী রায়হান মিয়া ও রাফিউল হাসান রাব্বি। এ বিষয়ে রায়হান মিয়া জানান, মামলা হওয়ার আগে স্থানীয় দলীয় নেতারা বলছিলেন, এই এলাকায় কয়েকজনের নামে মামলা হবে। তারা ভেবেছিল, আমি যোগাযোগ করে টাকা দেব। আমি অপরাধী নই, সে জন্য যোগাযোগ করিনি। এখন দেখছি আমার নামে মামলা দিয়েছে। আমি আন্দোলনের সময় কোথাও যাইনি, এলাকাতেই ছিলাম। জীবনে আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে ছিলাম না, তারপরেও আমার নামে মামলা দিয়েছে।
রংপুর মেট্রোপলিটন অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ) ড. আশিক মাহমুদ জানান, কোনো নিরীহ লোক যাতে হয়রানির শিকার না হয়, এ জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ঢাকা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাসাপেক্ষে মামলা তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামি গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আমিনুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন জায়গায় মামলা বাণিজ্যের বিষয়ে শুনেছিলাম। কিন্তু আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। আমরা মামলা বাণিজ্য ঠেকাতে তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সুপারদের নির্দেশনা দিয়েছি।
এনএইচ