অতীতের সুন্দর কোনো দিনে হারিয়ে যায় মন, যেদিন চারপাশে ঠিক, এই ঘ্রাণটাই ছিল। হয়তো একলা বিকেলে হাতে ছিল একখানা গল্পের বই কিংবা একগুচ্ছ ফুল। হয়তো মুচমুচে খাবারের সঙ্গে জমেছিল তুমুল আড্ডা। এভাবেই ফিরে ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া সময়।
সোঁদা মাটির ঘ্রাণে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেও রোজকার খাওয়াদাওয়া তো আর বন্ধ থাকবে না। বর্ষা মানেই খিচুড়ির ঘ্রাণ। ইলিশ না হোক, শর্ষের তেলে মাখানো আলুভর্তা দিয়ে একথালা গরম খিচুড়ির আয়োজন করতেই পারেন। ঘ্রাণে, ঝাঁজে ভরে উঠবে খাবার টেবিল। সঙ্গে একটুকরা লেবু আর একখানা টাটকা ঝাল মরিচ যোগ হলে তো কথাই নেই! বোম্বাই মরিচের ঘ্রাণটাও ঝালপ্রেমীদের টানে।
কোনো কোনো বিকেলে সাদামাটা মুড়িও শর্ষে তেল, আচার আর চানাচুরের সহযোগে হয়ে ওঠে অসাধারণ। সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা…আহ, আর কী চাই!
মিষ্টি ঘ্রাণের ফুলেরাও তো এই বর্ষাতেই ফোটে। ফুলের ঘ্রাণে জুড়ায় মনপ্রাণ। কদম, বেলি, বকুল, কাঠগোলাপ, দোলনচাঁপা, হাসনাহেনা, টগর, কামিনী, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, জুঁই, রেইন লিলি, স্পাইডার লিলি—তালিকাটা বেশ লম্বা।
সব কটিই যে শুধু বর্ষায় ফোটে, তা নয়। কিছু ফুল বছরের অন্য সময়েও ফোটে। তবে বর্ষার মায়াময় প্রকৃতিতে সেসব ফুলের ঘ্রাণকেও মনে হয় একটু আলাদা। কদম ফুলের ঘ্রাণ বর্ষার এক ‘ট্রেডমার্ক’। শহুরে জীবনে সড়ক বিভাজকের ওপর বা পথের পাশে পড়ে থাকা বকুল ফুলেরা ঘ্রাণ ছড়ায়, পিষ্ট হয় পথিকের পায়ের তলে। ট্রাফিক সিগন্যালেও ফুলের তোড়া বয়ে আনে পথশিশুর দল। বিক্রি হতে থাকে বেলি ফুলের মালার ছড়া কিংবা দোলনচাঁপার তোড়া।
‘রঙ বাংলাদেশ’-এর প্রধান নির্বাহী সৌমিক দাস বলেন, ‘প্রকৃতিতেই ছড়িয়ে আছে নীল রং। বিশেষ করে আকাশ, মেঘ আর পানিতে ভেসে বেড়ায় কত নীল। মেঘে ঢাকা আকাশ আর বর্ষার ভেজা ভেজা আবহে নীল রঙের প্রতি আকর্ষণ যেন বেড়ে যায়। ফ্যাশন হাউসগুলো ব্লক প্রিন্ট, স্ক্রিন প্রিন্ট, বাটিক, টাই-ডাই, শিবোরি ডাই, হাতের কাজ কিংবা ডিজিটাল প্রিন্টসহ নানা মাধ্যমে পোশাকে নীল রঙের কাজ করে।
হালকা নকশার পোশাকেই হয় বর্ষাযাপন। ভিজলে দ্রুত শুকিয়ে যায়, বর্ষায় এমন বৈশিষ্ট্যের হালকা, আরামদায়ক কাপড়ের পোশাক চাই। সুতি, ভিসকস, স্লাব কটন, লিনেন, সিনথেটিকের হালকা ধাঁচের কাপড় এ সময়ের উপযোগী।
নীল রঙের বহু ধরন। সব কটি না হলেও অনেকগুলো শেডই বর্ষায় মানানসই, জানালেন সৌমিক দাস। উদাহরণ হিসেবে বর্ষার আদি রং ইনডিগো বা গাঢ় নীল, একটু কালচে ধাঁচের নীল বা মিডনাইট ব্লু, প্রকৃতির সজীবতার প্রতীক নীল সবুজের মিশ্র শেড টিল ব্লু, ভারিক্কি ধরনের ধূসর ব্লু বা স্টিল ব্লুর কথা বলছিলেন তিনি।
নীলের সঙ্গে সাদার একটা সমন্বয়ও বর্ষায় দেখা যায়। দেখা যায় থিমভিত্তিক কাজ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘নীল-সাদার সমন্বয়ে আসে শুদ্ধতা, শান্ত প্রকৃতিতে আসে উজ্জ্বলতা। তবে বর্ষায় আরও কিছু রং নীলের সঙ্গে দারুণ মানাবে। শর্ষে হলুদ আনে প্রাণের ছোঁয়া।
বর্ষার সঙ্গে দারুণ সংগতিপূর্ণ আরেক রং হলো ধূসর। মাটি ও বৃষ্টির টোন তুলে ধরে মরিচা লাল। প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করে জলপাই সবুজ। তবে বর্ষা শুধু রং নয়, অনুভূতিরও উৎস। তাই এ সময় বিষয়ভিত্তিক পোশাক জনপ্রিয় হয়। ‘রঙ বাংলাদেশ’-এর এবারের থিম আবহমান বাংলার চিরন্তন বর্ষার প্রতীক কদম ফুল।’
হারমনি স্পার আয়ুর্বেদিক রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা বলছিলেন, বর্ষায় প্রকৃতিতে থাকে প্রশান্তির পরশ। এই মৌসুমে জমকালো নয়, হালকা মেকআপই মানানসই। এতে নিজের স্বাভাবিক সৌন্দর্য দারুণভাবে ফুটে ওঠে। ফুলের ব্যবহারে সাজে আসে স্নিগ্ধতা। হাতে থাকতে পারে বেলি কিংবা বকুল ফুলের মালা।
চুলের একপাশে আটকে নেওয়া যায় সতেজ কাঠগোলাপ কিংবা কদম ফুল। নীলবরন শাড়ির সঙ্গে কপালে থাকতে পারে একখানা টিপ। আর ফুল তো রইলই। ঘ্রাণে, সাজে সৃষ্টি হবে এক ভিন্ন আমেজ।
সায়েন্স ল্যাব মোড়ে দেখা এক বয়োবৃদ্ধ নারীর কথা মনে পড়ছে। মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে পেটের দায়ে কিছু বেলি ফুলের মালা নিয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনে পড়ছে, বেশ কজন তরুণ তাঁর কাছ থেকে মালা কিনছিল সেদিন। পথে পথে ফুলের মালার বিপণন অবশ্য খুব কম দিনই জমে ওঠে।
ব্যস্ততায় পথ ছুটতে ছুটতে কিংবা রিল দেখতে দেখতে কোনো মোড়ে দাঁড়ানো বৃদ্ধা কিংবা গাড়ির জানালায় টোকা দেওয়া পথশিশুর দিকে তাকানোর সময় থাকে কজনের! বৃষ্টিতে ভেজা কিংবা মেঘের খেলা বা বৃষ্টির ধারা দেখার বিলাসিতাটুকুও থাকে না অধিকাংশ মানুষের ব্যস্ত জীবনে। পেশার পেছনে ছুটতে ছুটতে প্রকৃতির রূপবদলটাকে অনুভব করা হয় না।
পাশে থাকা প্রিয়জনকে ‘ভালোবাসি’ বলা হয় না, ঘরে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটিকে একটু সময় দেওয়া হয় না। তবে আজকের এই দিনটা কিন্তু আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। হয়তো কাউকে কিছু একটা বলার কিংবা কারও জন্য কিছু একটা করার সুযোগ আপনি আর পাবেন না আগামীকাল।
তাই আজকের বর্ষার ঘ্রাণটাকে উপভোগ করুন মন ভরে, আপনজনদের সঙ্গে নিয়ে। কেবল পথঘাট আর প্রকৃতিই নয়, এই বর্ষায় সিক্ত হোক হৃদয়ও।